অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি আমলাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। শেখ হাসিনার ৫ জানুয়ারির একদলীয় সংসদ নির্বাচনে যখন বিএনপি-জামায়াত জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়, তখন শেখ হাসিনা চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। আর একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়ার পর শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ আমলা, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা দখল করে দেয়ার আশ্বাস দেয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মূলত সরকারি আমলা, র্যাব-পুলিশ আর বিজিবিই করেছিল। তাদের সহযোগিতায়ই শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়।
এরপর শেখ হাসিনা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সরকার গঠনের পর র্যাব-পুলিশ-বিজিবি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্নভাবে সুযোগ সুবিধা দিতে থাকে। প্রশাসনের লোকজনও বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা পেয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকে যা করা দরকার তাই করে। একটা পর্যায়ে তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।
তারপর, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যখন সব দল অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয় তখন আবার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় শেখ হাসিনা। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছিল জনমত ততই বিরোধী জোটের পক্ষে চলে যায়। এতে করে হাসিনার অস্বস্তির আরও বেড়ে যায়। কারণ, শেখ হাসিনা জানে-ক্ষমতা হাতছাড়া হলেই তাকে কারাগারে যেতে হবে। দলের দুর্নীতিবাজ, খুনী ও লুটপাটকারীরা হয়তো জেলে নয়তো দেশ ছাড়তে হবে। এছাড়া জনগণের রোষানলের শিকার তো হতেই হবে। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা আবারো প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়। তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও পদোন্নতিসহ নানান সুবিধা দিতে থাকে। তাদের কাজ হবে-যেকোনো ভাবেই হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। র্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সরকারি আমলারা হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে দিনের ভোট রাতেই শেষ করে ফেললেন। তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়েও ভোট ডাকাতিতে সহযোগিতা করে শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনলেন।
এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ-নেতাকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে নতুন খেলা শুরু হয়। তারা যে রাষ্ট্রের কর্মচারী সেটা ভুলে গিয়ে নিজেদেরকেই জনগণের শাসক মনে করতে শুরু করলেন। আর শেখ হাসিনাও এমপি-মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে আমলাদের দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেন। কোনঠাসা হয়ে পড়েন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। এসব নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা। কিছু দিন আগে সংসদে প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল-আওয়ামী লীগ ও আমলাদের মধ্যে এতদিন ন্সায়ু যুদ্ধ চলে আসলেও ইদানিং তা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে-বরিশালের ঘটনা।
বরিশানের ঘটনার পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছেন, একজন ইউএনও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের আক্রমনের শিকার হয়েছে। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সমস্ত জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বরিশালের মেয়র যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ঠ সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর হুকুমেই এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে তারা মনে করেন। অতএব, অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার দাবি করছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।
প্রশাসনের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় উঠে।
দেখা গেছে, এই আমলা আজ যাদেরকে দুর্বৃত্ত বলছে-তারাই একদিন এই দুর্বৃত্তদেরকে ভোট ডাকাতির সুযোগ দিয়ে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। সারাদেশের মানুষ জানে বরিশাল সিটিতে কোনো নির্বাচন হয়নি। প্রশাসনের সহযোগিতায় সাদিক আব্দুল্লাহ ভোট ডাকাতি করে মেয়র হয়েছে।
অন্যদিকে বিবৃতির ভাষা নিয়ে প্রশাসনে ‘দ্বিমত’, সরকারের ভেতর অস্বস্তি বিরাজ করছে। শুধু তাই নয় ঐ বিবৃতির কিছু ভাষা নিয়ে সচিব এবং প্রশসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল।
পরিচ্ছন্নতা অভিযানকে কেন্দ্র করে গত ১৮ই অগাস্ট বুধবার রাতে বরিশালের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান শোভনের বাসভবনে হামলা করে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা।
ঐ ঘটনার পরের দিন রাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরি সভার পর হামলার ঘটনায় একটি বিবৃতি দেয়া হয়। এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বরিশালের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একজন নির্বাহী অফিসার কীভাবে ”রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের” দ্বারা হেনস্থা হয়েছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সত্যকে সত্য বলা এখন হেনস্থা বলা হচ্ছে। সেখানে সরকার দলীয় নেতা কর্মীরা হামলা চালিয়েছে এটা স্পষ্ঠ। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। বিবৃতিতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ব্যবহার করে অস্পষ্ঠতা রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ দুর্বৃত্ত শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন ছিলো। এছাড়া আমলারা এখন এই হামলার বিরুধীতা করছে কিন্তু এই হামলাকারীদের ক্ষমতায় বসিয়েছে তারাই। এখন তার ফল ভোগ করছে।
Discussion about this post