বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সেন্সরশিপ নিয়ে বর্তমানে যা আলোচনা হয় তাতে টিভি বা পত্রিকার উপর আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বত নিয়ন্ত্রণ নিয়েই কথা হয়। এই নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার জন্য সরকারের হাতে বহু অস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে বড় একটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা প্রয়োগ করে এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন সাংবাদিক ও সম্পাদককে গ্রেফতার ও কারাবন্দী করা হয়েছে। তবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল সেগুলোর মালিকদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা, অর্থাৎ গণমাধ্যমের মালিকরা যেন আওয়ামী লীগের পক্ষের হয় তা নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগ সরকার এটা অর্জন করে ফেলেছে।
দেশের টিভি চ্যানেলের এক তৃতীয়াংশই যে আওয়ামী লীগের নেতাদের মালিকানাধীন (সম্পূর্ন বা আংশিক) তা ছিল আমার আরেকটি কলামের বিষয়বস্তু। বহু পত্রিকার ক্ষেত্রেও অবস্থা একইরকম। এর মধ্যে দ্য ইনডেপেন্ডেন্ট এবং ঢাকা ট্রিবিউনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। গণমাধ্যমের মালিকানা নিজের লোকদের হাতে থাকলে কি প্রকাশ পাবে, কি পাবেনা তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। বাংলাদেশে টিভি ও পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিকতায় সরকার ও ক্ষমতাশালীদের তোয়াজ করে চলার যে প্রবণতা, তার কারণ জানতে হলে আপনাকে শুধু এই টিভি ও পত্রিকাগুলোর মালিক কারা তা দেখলেই চলবে।
সরকারের চাপে সাংবাদিকতায় যে তীব্র বাঁধা সৃষ্টি হয় তার গুরুত্ব ছোট না করেই বলা যায় যে একই রকম নিয়ন্ত্রণ এবং সাংবাদিকতার স্বাভাবিক কাজের অবরোধ ঘটে বাংলাদেশে গণমাধ্যমগুলোর কর্পোরেট মালিকানার ফলে, মালিক যে দলই করুক। এমনকি দল না করলেও একথা খাটে। কিন্তু এই সেন্সরশিপ নিয়ে খুব একটা কথা হয় না।
এর কারণ হলো দেশের প্রায় প্রতিটি প্রধান টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার পেছনে আছে অতি বিশাল সব কনগ্লমোরেট (বহু বৃহৎ ব্যবসার সমন্বিত মালিকানাধারি প্রতিষ্ঠান)। এবং অর্থনীতির অনেক গুলো খাতে ব্যবসা রয়েছে এই কর্পোরেট গোষ্ঠীদের। এ বছরের শুরুর দিকে ঢাকায় অবস্থিত সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে ২৩ টি বৃহৎ কনগ্লমোরেট চিহ্নিত করা হয় যাদের প্রত্যেকের অন্তত একটি প্রধান সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের মালিকানা রয়েছে। এমন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের সংখ্যা নগণ্য যার সম্পুর্ন বা আংশিক মালিক কোন কনগ্লমোরেট না। এর মধ্যে একটি কনগ্লমোরেট — বসুন্ধরা — ৩ টি পত্রিকা, ১ টি টিভি চ্যানেল, ১ টি অনলাইন সাইট এবং ১ টি রেডিও স্টেশনের মালিক।
কনগ্লমোরেটের অধীনে গণমাধ্যম থাকার সমস্যা হলো নির্দিষ্ট খবর বা অনুসন্ধান প্রকাশের সাথে তাদের স্পষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত থাকে, এবং সেসব প্রকাশ হলে তাদের অন্যান্য ব্যবসার জন্য তা অসুবিধাজনক হতে পারে। এই সমস্যা বিশেষত বাংলাদেশে প্রকট, কেননা এখানে মালিকের ভূমিকা ও সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের মাঝে কোন সীমারেখা টানা হয়না। এবং বাংলাদেশে যেহেতু কনগ্লমোরেটগুলোর ব্যবসার পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে আছে, তাদের মালিকানার প্রভাবও তাই হতে পারে অত্যন্ত ব্যাপক।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে তিনটি খাতে বিশেষ করে এই কনগ্লমোরেটগুলোর উপস্থিতি রয়েছে: জ্বালানী, আবাসন (রিয়েল এস্টেট), এবং আর্থিক খাত। এই প্রত্যেকটি খাতই দুর্নীতি ও অসাধু কার্যক্রমের জন্য কুখ্যাত, এবং সেসবের প্রায় কিছুই খবরে প্রকাশ হয় না।
প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি — নিচের ছকে বিস্তারিত — গণমাধ্যমের মালিকানাধারি ২৩ টি কনগ্লমোরেটের প্রত্যেকেই এই তিন খাতের অন্তত একটিতে ব্যাবসা করে। এর মাঝে তিনটি প্রতিষ্ঠানের (বেঙ্গল, ইউনিক, এবং আরএকে সিরামিক) সবগুলো খাতে ব্যবসা আছে, এবং ১২টির তিনটি খাতের মাঝে দুটি খাতে ব্যবসা আছে। গণমাধ্যমের মালিকানাধারি কনগ্লমোরেটের মধ্যে ১৫টির জ্বালানী খাতে ব্যবসা আছে, ১১টির আবাসন খাতে, এবং ১৫টির ব্যবসা আছে আর্থিক খাতে। যে ১৫টির আর্থিক খাতে ব্যাবসা রয়েছে তার মাঝে ১০টির বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা এবং ৮টি প্রতিষ্ঠানের ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মালিকানা আছে।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিস প্রকাশিত “হু ওউনস মিডিয়া ইন বাংলাদেশ” প্রতিবেদন থেকে নেয়া তথ্য
এই খাত গুলোর অনিয়ম-অন্যায় নিয়ে টিভি ও সংবাদপত্রে প্রতিবেদনের ঘাটতি দেখে আসলে অবাক হবার কিছু থাকেনা যখন গণমাধ্যমের একটি বিশাল অংশের স্বার্থ এসব খাতের সাথে সরাসরি জড়িত। জ্বালানী ও ব্যাংকিং খাতে যাদের মালিকের ব্যবসা আছে, সেসব সংবাদমাধ্যম জ্বালানী খাতে প্রকিউরমেন্টে দুর্ণীতি এবং ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাফির সংবাদ কিভাবে প্রচার করেছে তা নিয়ে গুরুত্বপুর্ন একটি অনুসন্ধান হতে পারে।
অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া, কনগ্লমোরেটগুলো সাংবাদিকতায় আগ্রহের কারণে টিভি এবং সংবাদপত্রের পেছনে টাকা ঢালে না। স্বাধীন সাংবাদিকতাকে সুযোগ দেবার জন্য তো নয়ই। এখান থেকে তাদের কোন টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যও থাকেনা। তারা সংবাদমাধ্যম তৈরি করে তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরির উদ্দেশ্যে, এবং সর্বোপরি তাদের বিশাল ব্যবসার স্বার্থকে আরো সুরক্ষিত করতে।
লেখক: ডেভিড বার্গম্যান, ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।
Discussion about this post