ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ মিয়ানমারের খামপেট শহরে থা পেংকে যখন তার সাবমেশিনগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, পুলিশের এ ল্যান্স কর্পোরাল তখন ওই আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
“পরদিন এক কর্মকর্তা আমাকে ডেকে জানতে চান, আমি গুলি করবো কিনা,” থা পেং তখনও ‘না’ বলেন এবং পরে বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
এর পরদিন, ১ মার্চ তিনি বাড়ি ও খামপেটে থাকা পরিবারের সদস্যদের পেছনে ফেলে সীমান্তের দিকে রওনা হন; তিন দিনের পথচলা শেষে পৌঁছান ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় মিজোরাম রাজ্যে। ধরা পড়া এড়াতে তাকে বেশিরভাগ সময় রাতেই ভ্রমণ করতে হত।
“আমার আর অন্য কোনো বিকল্প ছিল না,” অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেন থা পেং।
পরিচয় গোপন রাখতে তিনি কেবল তার নামের একাংশ দিয়েছেন; রয়টার্স তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পুলিশের পরিচয়পত্র দেখেছে।
থা পেং জানান, ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ও তার আরও ৬ সহকর্মী এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ অমান্য করেন। ওই কর্মকর্তার নাম বলেননি তিনি।
রয়টার্স স্বতন্ত্রভাবে থা পেংসহ মিয়ানমার-ভারত সীমান্তে জড়ো হওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের বলা কথাবার্তার সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
তবে ২৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে থা পেংয়ের বর্ণনার সঙ্গে ১ মার্চ সীমান্ত টপকে মিজোরামে ঢুকে পড়া মিয়ানমার পুলিশের আরেক ল্যান্স কর্পোরাল ও তিন কনস্টেবলের কথার মিল পাওয়া গেছে বলে ভারতীয় পুলিশের অভ্যন্তরীণ এক গোপনীয় নথি দেখে জানিয়েছে রয়টার্স।
মিজোরামের পুলিশ কর্মকর্তাদের লেখা ওই নথিতে ৪ জনের বিস্তারিত তথ্য এবং কেন তারা পালিয়ে এসেছে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
“বিভিন্ন স্থানে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ ও আইন অমান্য আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে আমাদেরকে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের লোকজন, যারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছে, তাদের উপর গুলি করার হিম্মত নেই আমাদের,” মিজোরাম পুলিশকে এমনটাই বলেছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পুলিশ সদস্যরা।
এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে রয়টার্স মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটিতে অভ্যুত্থানবিরোধী টানা আন্দোলন চলছে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের সরব অবস্থানের জানান দিচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের সরাতে নিরাপত্তা বাহিনীকেও প্রায় প্রতিদিনই কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট এমনকি তাজা গুলি ছুড়তে হচ্ছে।
দেশটিতে এবারের সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন; এর পাশাপাশি এক হাজার ৮০০-র বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যাসিস্টেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিকাল প্রিজনার্স।
নিহত ও বন্দিদের এ সংখ্যা সঠিক কিনা, তা যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ‘দাঙ্গাবাজ বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের’ মুখেও নিজেরা সর্বোচ্চ সংযম দেখাচ্ছে বলে দাবি করছে। বিক্ষোভকারীরাই পুলিশের উপর হামলা চালাচ্ছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও অভিযোগ তাদের।
মিয়ানমারে এ অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির প্রায় ১০০ নাগরিক সীমান্ত টপকে ভারতে ঢুকে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন এক ভারতীয় কর্মকর্তা।
এদের বেশিরভাগই পুলিশ ও তাদের পরিবারের সদস্য, বলেছেন তিনি।
মিয়ানমারের এ নাগরিকদের অনেকেই মিজোরামের চামপাই জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানেই রয়টার্স তিনজনের সাক্ষাৎকার নেয়, যারা মিয়ানমারে থাকতে পুলিশ বাহিনীতে কাজ করেছে বলে জানায়। এদেরই একজন থা পেং।
নিজের পরিচয়পত্রগুলো দেখানোর পাশাপাশি তিনি তারিখবিহীন পুরনো একটি ছবিও রয়টার্সকে দেখান, যেখানে তাকে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে।
থা পেং জানান, তিনি ৯ বছর আগে পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন।
তার ভাষ্যমতে, মিয়ানমার পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী বিক্ষোভকারীদের থামাতে তারা রাবার বুলেট কিংবা বিক্ষোভকারীদের হাঁটুর নিচে গুলি ছুড়তে পারতেন।
“কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আদেশ দিয়েছিলেন না মরা পর্যন্ত গুলি করতে,” বলেছেন থা পেং।
একই কথা বলেছেন নগুন হ্লেই। ২৩ বছর বয়সী এ যুবক জানান, তিনি মান্দালয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাকেও বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
অবশ্য কবে, কেন তাকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি নগুন। পরিচয় গোপন রাখতে তিনিও রয়টার্সকে নামের একাংশ দিয়েছেন; তার কাছে তার জাতীয় পরিচয়পত্রও ছিল।
থা পেং ও নগুন হ্লেই দুজনেরই ধারণা, মিয়ানমারের পুলিশ দেশটির সামরিক বাহিনীর নির্দেশে এসব করছে। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি তারা।
ভারতীয় পুলিশের গোপন নথিতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অন্য ৪ পুলিশ সদস্যও একই মত পোষণ করেছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
নগুন হ্লেই জানান, গুলি করার আদেশ না মানায় তাকে তিরস্কার করার পাশাপাশি বদলি করা হয়। তিনি পরে অনলাইনে গণতন্ত্রপন্থি রাজনৈতিক কর্মীদের সহায়তা চান এবং ৬ মার্চ মিজেরামের ভাপাই গ্রামে পৌঁছান। এ যাত্রায় তার খরচ হয়েছে প্রায় ২ লাখ মিয়ানমারি মুদ্রা (১৪৩ ডলার)।
থা পেং আর নগুন হ্লেইয়ের মতোই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে ২৪ বছর বয়সী দালকে। উত্তরপশ্চিম মিয়ানমারের পাহাড়ি শহর ফালামে কনস্টেবল হিসেবে কাজ করা এ নারীর নাম যাচাই করেছে রয়টার্স; পুলিশ থেকে দেওয়া তার পরিচয়পত্রের একটি ছবিও দেখেছে তারা।
দালকে মূলত প্রশাসনিক কাজই বেশি করতে হতো; এসব কাজের মধ্যে ছিল পুলিশ যাদের আটক করেছে তাদের তালিকা বানানো। অভ্যুত্থানবিরোধী তুমুল আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাকে নারী বিক্ষোভকারীদের ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয়, যে আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানান দাল।
বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নেওয়ায় বন্দি হতে পারেন এ আতঙ্ক থেকেই পরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়া তিনজনই বলছেন, মিয়ানমার পুলিশের ভেতর বিক্ষোভকারীদের সমর্থকই বেশি।
“থানার ভেতর ৯০ শতাংশই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করে কিন্তু তাদের কোনো নেতা নেই যে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে,” বলেছেন স্ত্রী ও দুই মেয়েকে ফেলে পালিয়ে আসা থা পাং। তার এক মেয়ের বয়স মাত্র ৬ মাস।
পরিবারের সদস্যদের কথা মনে পড়লেও থা পাং জানান, মিয়ানমারে যেতে ভয় পাচ্ছেন তিনি।
“আমি ফিরে যেতে চাই না,” বলেন তিনি।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া এ পুলিশ সদস্যদের ফেরত পেতে এরই মধ্যে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে মিয়ানমার।
গত সপ্তাহে দেশটির ফালাম জেলার ডেপুটি কমিশনার মিজোরামের চামপাইয়ে ডেপুটি কমিশনার মারিয়া সিটি জুয়ালিকে লেখা এক চিঠিতে তাদের ৮ পুলিশ সদস্যকে ফেরত চেয়েছেন।
জুয়ালি ওই চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন, রয়টার্সও চিঠিটির একটি অনুলিপি দেখেছে।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা জানিয়েছেন, তার প্রশাসন পালিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের খাবার ও অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেও তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে কিনা সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
Discussion about this post