মিনার রশিদ
সৃষ্টি জগতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যে নর-নারীর মধ্যে জৈবিক কর্মটি অতি আবশ্যকীয়। বিষয়টিকে ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল করতে মানব সমাজে বিয়ে এবং পারিবারিক প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এই নিয়মের বাইরে গিয়ে যারা এই কর্মটি সংঘটিত করেন সেটাকে অবৈধ, অনৈতিক ও পরকীয়া ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয় । সেই একই কাজ জোরপূর্বক করা হলে তাকে বলা হয় ধর্ষণ। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে বা নাটক-সিনেমায় ধর্ষকের যে চেহারা-সুরত এতকাল যাবত তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবের ধর্ষকদের সাথে তাদের মিল খুবই কম। এটিও ধর্ষকদের জন্যে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এখানে খায় একজন, বিল উঠে অন্য আরেক জনের নামে। ক্রিমিনাল একদিকে, জাতির ঘৃণার কামানটি তাক করা অন্যদিকে। চাচার কবর একদিকে, চাচি জরিনা সুন্দরী কান্দে অন্যদিকে ফিরে।
একটি মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকার্যে বাধ্য করলে তাকে ধর্ষণ বলা হয়। কিন্তু আঠারো কোটি মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শাসন করে পুরো একটি জাতিকে যে ধর্ষণ করা হচ্ছে সেদিকে আমরা অনেকেই বেখেয়াল। সবচেয়ে বড় ধর্ষকের কাছে আমরা ছোট ছোট ধর্ষণের বিচার চাচ্ছি। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এর ফলে সোনার ছেলেদের খায়েশ মেটাতে আর জোরাজুরি করতে হবে না। তিন নম্বর কাজটি দুই নম্বর পন্থায় করা সম্ভব হবে।
এই বড় ধর্ষণের সাথে ছোট ছোট ধর্ষণের তো সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এই ধর্ষকরা জানে তাদের বিচার হবে না। সরকার ও প্রশাসন জনগণকে ঠাণ্ডা করার জন্যে একটু লেফট-রাইট করে ঠিকই এদের ছেড়ে দিবে। আওয়ামী জমানায় ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার এটিই মূল কারণ।
প্রত্যেকটা সমাজের মোরাল ব্রিগেড একেক উপাদান দিয়ে তৈরি। আমাদের দেশে এই মোরাল ব্রিগেডের অন্যতম উপাদান হলো ধর্মীয় বোধ। আওয়ামী লীগ এটিকেই প্রথমে আঘাত করে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পলিসি হলো গোড়া কেটে আগায় পানি দেয়া। নামাজ শিক্ষার বইকেও ওসি প্রদীপ কুমাররা জিহাদি বই নাম দেয়। আওয়ামী লীগের সবাই নাস্তিক-মুরতাদ নয় কিন্তু নাস্তিক-মুরতাদদের শতভাগ আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। এর পরেও আলেম সমাজের একটি অংশের সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের অসুবিধা হয় না।
গণ নৈতিকতার ভিতটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে এই আওয়ামী লীগ। চরিত্রগতভাবে এরা আসলে ভোগবাদী। ধর্মকে অপছন্দ করার মূল কারণ- সীমাহীন ভোগবাদে ধর্ম সবচেয়ে বড় বাঁধার সৃষ্টি করে। জীবনের সকল কাজে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করে ধর্ম। এই বিষয়টি মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকলে ভোগের পেয়ালাটিকে শতভাগ পূর্ণ করা যায় না। খাও দাও ফুর্তি করার দর্শন থেকেই মূলত: ধর্ষণ কালচারের উৎপত্তি। কেউ টাকা দিয়ে, কেউ ক্ষমতার জোরে, কেউ সাংস্কৃতিক সুষমা দিয়ে শিকারকে নিজের করে নেয়। একই জীবন দর্শনের অনুসারী যাদের হাতে এই তিন অস্ত্রের একটির বা দুটির অভাব থাকে, সেই আনকোরারাই জোর করে শিকারকে ধরতে যান। এদের মধ্যে জটিলটি হলো যারা দুই নম্বর (পরস্পরের সম্মতিতে) কাজটি করে পরবর্তী সময়ে তিন নম্বর (ধর্ষণের) কাজের অভিযোগ তুলে। নুরুদের উপর ধর্ষণের অপবাদ দেয়া মেয়েটিকেও এখন বোরখা পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। অথচ কথিত ধর্ষণ কর্মটি যখন সংগঠিত হয় তখন কিন্তু গায়ে বোরখা ছিল না, হাসিমাখা মুখটি খোলাই ছিল। এক্ষেত্রে দাম্পত্য প্রতারণার মত বিষয়টিকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমাদের কাছে এখন তিন নম্বর কর্ম বা ধর্ষণটি যেমন মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে, তেমনি এক সময় পশ্চিমা বিশ্বের পুরুষদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের অবিশ্বস্ততা। সকল যুগের শামসুর রাহমানরা (পরকীয়ায় পাপ নেই বলে যে কবি ফতোয়া দিয়েছিলেন) একই কিসিমের হয়ে থাকে। “আমার বউ আমার, তোমার বউ আমার”। সমস্যা সমাধানের জন্যে পশ্চিমা দেশের পুরুষকুল তাদের অবিশ্বস্ত স্ত্রীদের নিম্নাঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি লোহার বর্ম পরিয়ে রাখতেন। বিশেষ করে বাণিজ্য বা অন্য কোনো কারণে পরদেশে সফরে গেলে এই ধরণের সেইফটি মেকানিজম বা প্রতিরক্ষার প্রয়োজন বেশি করে অনুভূত হত। সেই বিশেষ বর্মে তালা মেরে অত্যন্ত প্রশান্তচিত্তে বাড়ি থেকে বের হতেন।
ধর্ষণ বন্ধে ইদানিং অনেক বিশেষজ্ঞের মনে একই কিসিমের সেইফটি মেকানিজমের চিন্তার উদ্ভব হয়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন বোরখাও একই কাজ করতে পারে। বোরখার উপর এই ধরণের মাত্রাতিরিক্ত আস্থা থেকে কোনো কোনো প্রবাসী স্ত্রীকে বোরখা পাঠিয়ে দিয়ে বছরের পর বছর বিদেশে কাটান। অথচ হতভাগা মেয়েটির জন্যে দরকার ছিল স্বামীর সান্নিধ্য, বোরখা নয়। স্বামীর কাজ বোরখা দিয়ে হবে না। এটা শুধু ঐ মেয়েটির সাথে মশকরা নয়, বোরখা নামক পোশাকটির উপরেও জুলুম বটে। বেচারা বোরখাকে যে কাজের জন্যে তৈরি করা হয়েছে তার চেয়ে অতিরিক্ত কাজের ভার চাপানো জুলুমের নামান্তর। মেয়েদের মডেস্টি রক্ষার জন্যে যে বোরখার সৃষ্টি তাকে এখন ধর্ষণ থেকে রক্ষার জন্যে বলা হচ্ছে।
অথচ এটি বোরখার কাজ নয়, এটি আইনের শাসনের কাজ। ধর্ষণ বন্ধের জন্যে সর্বাগ্রে দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। এই আইনের শাসনের অভাবেই আজ ধর্ষণ সর্বগ্রাসীরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে ততবারই এ দেশের নারী সমাজ আর অর্থনীতি- উভয়েই চরম সংকটে পড়েছে। আওয়ামী শাসনে সংকটে পড়াদের মধ্যে এরকম অনেক কিছুই আছে। তবে আওয়ামীলীগের হাতে কেন যেন বেশি কাহিল হয় এই দুই অবলা। যাই হোক, এক অবলার জন্যে দারুণ পরামর্শ দিয়েছেন প্রাক্তন আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। মা-বোনদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, কোথায়ও যাওয়ার আগে খোঁজ নেন সেখানে ছাত্রলীগ আছে কি না। শুধু আওয়ামী বিদ্বেষীদের চোখেই বিষয়টি ধরা পড়ছে, এমন নয়। আওয়ামী প্রেমিক বলে বিবেচিতরাও মুখ খোলা শুরু করেছে। মহাজোটের সঙ্গী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, “ করোনা, ধর্ষণ, দুর্নীতি আর লুটপাটে বিপর্যস্ত দেশ। চট্টগ্রামের প্রাক্তন মেয়র ও আওয়ামীলীগ নেতা নাসির বলেছেন, ধর্ষণ বাড়ার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। এই নেতা বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও বাস্তবতাকে বোধহয় অস্বীকার করতে পারছেন না।
নেহায়েত একটা প্রোপাগান্ডার জন্যে এই শিরোনামটি দেয়া হয় নাই। বরং সকল নিরপেক্ষ গবেষকদের আহ্বান জানাতে চাই, বিষয়টি নিয়ে মুক্তভাবেই গবেষণা করতে। আপনাদের তথ্য উপাত্তে বা গবেষণায় যদি অন্য কোনও সরকারের সময়কে অধিকতর ভয়াবহ মনে হয়, তাতে আমার কোনও আপত্তি থাকবে না। এই পাবলিক পারসেপশন বা ভাবনাটি নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা চলুক, সমাজের সর্বস্তরে রুট কজ এনালাইসিসের ভাবনাটি ছড়িয়ে পড়ুক।
বিএনপি বা অন্য কোনও সরকারের আমলে ধর্ষণ ছিল না- এমনটা নয়। বরং আওয়ামী জমানায় এটি কেন বেড়ে যায়, আজকের আলোচনার মূল প্রশ্নটি এখানেই।
একই মাটি থেকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের জন্ম। খাসলত বা বেসিক হিউম্যান কোয়ালিটি বিবেচনায় দু’টি দলের নেতাকর্মীর মধ্যে পার্থক্যটি হলো উনিশ বিশ। সুযোগ মানুষকে চোর বানায়। এই সুযোগটি আওয়ামী লীগের জমানায় নানা কারণে অধিক মাত্রায় সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগ যে যুগটিকে তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের যুগ বলে তুলে ধরতে চাচ্ছে সেই যুগ সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য উপাত্ত নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘নব্য রাজাকার’ পিনাকী ভট্টাচার্য। হুমায়ূন আহমেদ তার এক উপন্যাসে টঙ্গীর মোজাম্মেল নামক যে ধর্ষকের কথা লিখে গেছেন লোকজন তাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছে আর ভাবছে অতি শীঘ্রই সেঞ্চুরিয়ান মানিকও এমপি মন্ত্রী হয়ে পড়বে । হরগঙ্গা কলেজের সেই প্রাক্তন ভিপি মৃনাল কান্তি বিএনপি নেত্রী নিলুফার মনিকে আদর করার খায়েশ প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্য টিভি ক্যামেরার সামনে। এদের ঔদ্ধত্য কোন্ পর্যায়ে পৌছে গেছে তা সহজেই অনুমেয় ।
বাকশালের দর্শনের মাঝেই ধর্ষণের দর্শন মিশে আছে। বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি আমাদের উপলব্ধিতে ঢুকবে, জাতির মুক্তি তত তরান্বিত হবে ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট