হাসান রূহী
||১||
২০১৩ সাল। ইতিহাস ভেঙে বিচারিক আদালতের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে অন্যতম শীর্ষ জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ থেকে। শাহবাগে একদল চরিত্রহীন নাস্তিকের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে হত্যার আয়োজন চলতে থাকে বিভিন্নভাবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়া হবে। তাতে আইন ও বিচার যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়েও গুরুত্ব পেয়ে গেল শাহবাগের কথিত সেই গণজাগরণ মঞ্চ। বিচারের নামে আদালতে আসলে কি হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। প্রতিবাদে ফেটেও পড়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিবাদ মিডিয়ার দৃষ্টিতে ছিল গুরুত্বহীন। কোনো কোনো মিডিয়া তো জনগণের এই প্রতিবাদকে সহিংসতা ও সন্ত্রাস বলে প্রচার করেছে।
১৯৯২ সালে অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে শুরু হয় কথিত গণ-আদালত এর কার্যক্রম। গড়ে তোলা হয় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। দেশের আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেই কথিত গণ-আদালতে গোলাম আযমকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। সেই থেকে শুরু। শুরুতে শুধু অধ্যাপক গোলাম আযমকে নিয়ে অ্যালার্জি থাকলেও পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় সেই অ্যালার্জির বিস্তৃতি ঘটে। অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াত থেকে অবসর নিলে দলের আমীর হিসেবে দায়িত্ব নেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। আগে রাজাকার হিসেবে শুধু গোলাম আযমকে চিহ্নিত করা হলেও এরপর থেকে তালিকা দীর্ঘ হওয়া শুরু করে। সেই তালিকায় নতুন করে নিয়ে আসা হয় জামায়াতের নব নির্বাচিত আমীর মতিউর রহমান নিজামীর নাম। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী দুঃশাসন ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে জনগণ। দুর্নীতির অভিযোগ এনে সব দলের নেতা-নেত্রীদের জড়ানো গেলেও একমাত্র জামায়াত নেতাদের সেই অভিযোগে ঘায়েল করা যায়নি। সেই থেকে রাজাকার ইস্যুকে সামনে আনার চেষ্টা শুরু হয় নতুন উদ্যোমে।
এরপর থেকে শুরু হয় বিবর্তনের যুগ। রাজনীতির ময়দানে ঘায়েল করতে শুরুতে যাদেরকে বলা হতো ‘রাজাকার’, ধীরে ধীরে সেই শব্দের বিবর্তন ঘটিয়ে তাদের বলা শুরু হলো ‘যুদ্ধাপরাধী’। পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে সকল মিডিয়াকে ব্যবহার করে শুরু হয় সিন্ডিকেট নিউজ। সেখানে খুব সচেতনভাবে এই ‘যুদ্ধাপরাধী’ শব্দটি ব্যবহার শুরু হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কথিত মামলায় গ্রেফতার করা হয় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। বাম ও ভারতের মদদপুষ্ঠ মিডিয়াগুলোর সেই সিন্ডিকেট নিউজগুলোকে কাজে লাগিয়ে দাবি তোলা হয় ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’। ২০১৩ সালে এই দাবিকে সামনে রেখে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনা হয় সেই ১৯৯২ এর গণ-আদালতের পুরানো মদ। তবে তা আনা হয় গভীর পরিকল্পনার আলোকে নতুন বোতলে। নাম দেয়া হয় গণজাগরণ মঞ্চ। সেখানে কথিত চেতনার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় বাম সমর্থিত আওয়ামী লীগ।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় রাজাকার থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ শব্দটি ব্যবহার শুরু হলো কেন? উত্তর হলো, যখন রাজাকার শব্দটি জামায়াতের সাথে জুড়ে দিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছিল তখনকার জনগণের মধ্যে মূলত রাজাকার সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট ছিল না। পরে যখন জানা গেল রাজাকার কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি, বরং এর গঠন হয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায়। তখন বুঝা গেল এই শব্দ ব্যবহার করে মূলত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের খুব একটা ফাঁসানো যাবে না। এরপর ‘যুদ্ধাপরাধ’ বিষয়টাকে সামনে রেখে ‘যুদ্ধাপরাধী’ শব্দের ব্যবহার বাড়ানো হয়। এ শব্দের আরেকটা সুবিধা ছিল, আন্তর্জাতিক ফ্লেভার যুক্ত করা। কিন্তু পরে যখন বুঝা গেল জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও খুব একটা আনা যাবে না। তখন শুরু হলো নতুন আরেকটি শব্দের ব্যবহার। আর তা হলো ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’। এই শব্দের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার আগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা। ফলে এক প্রকার তড়িঘড়ি করেই হত্যা করা হয় জামায়াত নেতাদের। কালের পরিক্রমায় হয়তো এই তড়িঘড়ি বিচারের নামে প্রহসনের মূল সত্য উদঘাটন হবে, কিন্ত সে জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা আমাদের কারোরই জানা নেই।
||২||
বিচার অবিচারের এই ইতিহাস টেনে আনার কারণ হয়তো এরই মধ্যে অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। যাদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয় তারা ভাবতে থাকুন, মনে করতে থাকুন বিষয়গুলো। তবে শব্দের বিবর্তনের মাধ্যমে যারা আদালতকে নির্লজ্জভাবে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধ্য করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কারিগর ছিলেন সদ্য প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আইন আদালত পরের কথা, তার কথাই যেন ছিল আইন। আপিল বিভাগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় অব্যাহত রাখা হলে রায়টির রিভিউ আবেদন করতে চান তার আইনজীবিরা। কিন্তু সে আইনি ব্যাপারটিকে গ্রাহ্য না করে অনেকটা গায়ের জোরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ঘোষণা করেন- ‘‘এই মামলায় রিভিউ আবেদনের কোন সুযোগ নেই।”
ব্যস! আদালতের দিকে না তাকিয়ে মাহবুবে আলমের এই কথার উপরেই ভিত্তি করে আ: কাদের মোল্লাকে ‘কসাই কাদের’ এর দায় চাপিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়।
||৩||
মানুষ চিরদিন থাকে না। কিন্তু থেকে যায় তাদের কীর্তি, তাদের ইতিহাস। মিডিয়ার সামনে অতিমাত্রায় জামায়াত জামায়াত বলে চিৎকার করা সেই ইফা ডিজি শামীম আফজাল আর নেই। পাহাড়সম দুর্নীতির দায় আর অপমানকে সঙ্গী করে দুনিয়া থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। ১৯৯২ এর গণ-আদালতের ১০ জন বিচারকের অন্যতম একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীও সম্প্রতি বিদায় নিয়েছেন। হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে রিভিউ আবেদন করে অবশেষে বিদায় নিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। মিরাকল হচ্ছে এরা সবাই বিদায় নিয়েছেন মরণঘাতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
অন্যদিকে ইতিহাস ভেঙে সীমাহীন অপমান আর দুর্নীতির দায় নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। ঘুষ দাবি করে চোরের জিন্দেগী করছেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। রাজাকারের তালিকায় চকচক করছে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম। শাহরিয়ার কবিরদের মানুষ এখন ‘মুরগি কবির’ নামেই বেশি চেনে!
দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সেই ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্যই কতই না আয়োজন সবার। দুনিয়ার আদালতে ক্ষমতার জোরে হয়তো আমরা কারও রিভিউ পিটিশন চোখ বুজে বাতিল করে দিতে পারি। কিন্তু, সেই ক্ষমতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এমন কিছুই আমাদের কারও করা উচিত নয় যে তাতে কেউ মাজলুম হয়ে পড়ে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট