ডঃ খোন্দকার মেহেদী আকরাম
সম্প্রতি বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা দিল যে তারা করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেছে! এটা সত্যিই একটা বিরাট সাফল্য। এ পর্যন্ত তারা তাদের ভ্যাক্সিনের টার্গেট ডিজাইন করেছে এবং খরগোশের উপর পরীক্ষা করে সফলতা পেয়েছে। এখন তারা তাদের ভ্যাক্সিন টার্গেটগুলো পরীক্ষা করবে ইঁদুরের উপরে। এবং তাদের দাবি তারা এই ডিসেম্বরেই বাজারে ভ্যাক্সিন নিয়ে আসবে! এটা কী আসলেই সম্ভব?
আমি পেশাগত ভাবে একজন চিকিৎসক এবং বায়োমেডিক্যাল সাইন্টিস্ট। ভ্যাক্সিন তৈরীর সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও মলিকিউলার বায়োলজি, ক্লোনিং, ভাইরাল ট্রান্সডাকশন, ভাইরাল রিকম্বিনেশন, অ্যানিম্যাল মডেলিং, জীন সিকুয়েন্সিং ইত্যাদি নিয়েই আমার কাজ। সেই আলোকেই আমি এখানে আলোচনা করবো খুব সহজ ভাবে যে কিভাবে একটা ভ্যাক্সিন তৈরী করা হয়। এবং কিভাবে গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিন আলোর মুখ দেখবে।
একটা নতুন ভ্যাক্সিন কিভাবে তৈরী হয়?
প্রথম ধাপঃ ভ্যাক্সিন টার্গেট নির্বাচন
(১) ইন-সিলিকো টার্গেট অ্যানালাইসিসঃ
এটা এক ধরনের ডাটা বেইজ অ্যানালাইসিস যা বিশেষ ধরনের সফ্টওয়্যার ব্যাবহার করে কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয় (Bioinformatics)। জানুয়ারী থেকে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের হোল-জিনোম সিকুয়েন্স করা হয়েছে অনেক। সব সিকুয়েন্স ডাটা উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে NCBI ওয়েব সাইটে যাতে করে বিজ্ঞানীরা করোনার ওষুধ বা ভ্যাক্সিন তৈরী করতে পারে। করোনা ভ্যাক্সিন তৈরীর সবচেয়ে প্রাথমিক ধাপ হল হোল-জিনোম সিকুয়েন্স থেকে করোনা ভাইরাসের জীনের একটি বা কয়েকটি ছোট্ট অংশ (টার্গেট) নির্বাচন করা যেটা ব্যবহার করে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন তৈরী করা যায়। অক্সফোর্ড এবং চায়না এই পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন (S-protein) উৎপাদনকারী জীন সিকুয়েন্সকে টার্গেট করে তাদের ভ্যাক্সিন তৈরী করছে। যদিও গ্লোব বায়োটেক পরিস্কার ভাবে এখনও বলেনি ওদের টার্গেট কোনটা, শুধু বলেছে ওদের প্রাথমিক টার্গেট ৪ টি। গ্লোব বায়োটেকের প্রেস ব্রিফিং অনুযায়ী এই ধাপটি তারা সম্পন্ন করেছে।
(২) ভাইরাল ভেক্টর প্রিপারেশনঃ ল্যাবোরেটরী কার্যক্রম-
ডঃ আসিফ মাহমুদ তাদের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেনি কোন ধরনের ভ্যাক্সিন তারা আবিষ্কার করেছেন। তবে ধরে নিলাম তারা অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বেইজড ভ্যাক্সিন তৈরী করছে। অক্সফোর্ড এবং চায়নাও অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বেইজড ভ্যাক্সিন তৈরী করছে। অ্যাডিনোভাইরাস হল এক ধরনের নন-এনভেলপড ডি.এন.এ (DNA) ভাইরাস যার সংক্রমণে মানব দেহে সাধারন সর্দি-জ্বর হয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে অ্যাডিনো ভাইরাস থেকে কয়েকটি জিন সরিয়ে ফেলা হয় (E1 এবং E3 জিন) যাতে করে ভাইরাসটি শুধু সংক্রমণ করতে পারে কিন্তু হারিয়ে ফেলে এর বংশবিস্তার বা রিপ্লিকেশনের ক্ষমতা। এই পরিবর্তিতঅ্যাডিনো ভাইরাসটি কাজ করে ভ্যাক্সিনের ডেলিভারী ভেক্টর বা বাহক হিসেবে। অন্যদিকে, ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড ডি.এন.এ (Plasmid DNA) ব্যবহার করে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে তৈরী করা হয় পূর্বনির্বাচিত টার্গেট জিন এর DNA কপি। এর পরে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে সেল কালচারের মাধ্যমে এই টার্গেট DNA যেমন স্পাইক প্রোটিন জিনকে প্রবেশ করানো হয় অ্যাডিনো ভাইরাসের ভেতর। এভাবে তৈরী করা রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনো ভাইরাসটি তখন কোন কোষকে সংক্রমিত করলে তা ঐ কোষের ভেতরে তৈরী করে করোনা ভাইরাসের মত স্পাইক প্রেটিন। অর্থাৎ এই রুপান্তরিত অ্যাডিনো ভাইরাসটি তখন এক ধরনের নকল করোনা ভাইরাসের মত রূপ প্রদর্শন করে কিন্তু কোভিড রোগ তৈরী করতে পারে না। এই রুপান্তরিত অ্যাডিনোভাইরাসটিই ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গ্লোব বায়োটেকের ব্রিফিং থেকে জানা যায় যে তারা এই ধাপটি সম্পন্ন করেছে। তারা যদি অ্যাডিনো ভাইরাস বেইজড ভ্যাক্সিন না বানিয়ে DNA বা mRNA ভ্যাক্সিনও প্রস্তুত করে, তার পরও তারা এই ধাপটি সম্পন্ন করেছে।
যেহেতু gene deleted অ্যাডিনো ভাইরাস ভেক্টর এবং plasmid DNA এখন সহজলভ্য এবং করোনা ভাইরাসের জীনোম সিকুয়েন্স রেডি, তাই প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করতে ৩-৪ মাসের বেশী সময় লাগার কথা না। গ্লোব বায়োটেকের দাবী অনুযায়ী তারা কাজ শুরু করেছে মার্চের প্রথম থেকে। সে অনুযায়ী যদি তারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এই ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্ট প্রযেক্টে, তাহলে তারা প্রথম ধাপটি শেষ করে থাকবে মে মাসের ভেতরেই। এর পরের ধাপটি হল ভ্যালিডেশন।
দ্বিতিয় ধাপঃ ভ্যাক্সিন টার্গেট ভ্যালিডেশন (প্রি-ক্লিনিক্যাল অ্যানিম্যাল ট্রায়াল)
(১) প্রিলিমিনারী অ্যানিম্যাল এক্সপেরিমেন্ট:
এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে উৎপাদিত অ্যাডিনোভাইরাস ভ্যাক্সিন বা DNA ভ্যাক্সিনগুলি সরাসরি ইনজেক্ট করা হয় পশুর দেহে (যেমন ইঁদুর, খরগোশ বা বানর)। ইনজেকশনের ১৪ এবং ২৮ দিন পরে ঐ পশুর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে পশুর দেহে টার্গেট জীনের বিপরীতে এন্টিবডি তৈরী হয়েছে কী না। এই পরীক্ষায় যদি দেখা যায় যে পূর্বনির্বাচিত ৪ টা টার্গেটের ভেতরে ২ টা টার্গেটের বিপরীতে ইমিউন রেসপন্স হয়েছে এবং সঠিক এন্টিবডিটি তৈরী হয়েছে, তাহলে ঐ ২ টি টার্গেটকে পরবর্তি পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়।
গ্লোব বায়োটেকের ব্রিফিং থেকে জানা যায় যে তারা এই ধাপটি সম্পন্ন করেছে ৫ টি খরগোশের উপর। এবং তারা বলেছে যে তাদের ডিজাইন করা ৪ টি ভ্যাকসিন টার্গেটই খরগোশের দেহে সঠিক এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। এবং এই এন্টিবডিগুলো করোনা ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম। অর্থাৎ তাদের দাবী অনুযায়ী তাদের ভ্যাক্সিন খরগোশের দেহে ইমিউন রেসপন্স করাতে সক্ষম। আর এ পর্যন্ত আসতে তাদের সময় লেগেছে মোট ৪ মাস (মার্চ-জুন)। একজন বায়োমেডিক্যাল সাইনটিস্ট হিসেবে আমাকে বলতেই হবে যে তারা কাজ করেছে রকেটের গতিতে!
তবে কেন তারা প্রিলিমিনারী অ্যানিম্যাল এক্সপেরিমেন্ট ইঁদুরের পরিবর্তে খরগোশ ব্যবহার করলো তা বুঝতে পারলাম না। এই খরগোশ এক্সপেরিমেন্ট কী তারা সঠিক ভাবে BMRC থেকে অনুমাদন নিয়েছিলেন? Animal Act এবং Animal Licence অনুযায়ী ইদুরকে বাইপাস করে খরগোশে এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে তার যথাযথ জাস্টিফিকেশন থাকতে হবে। Animal rights সঠিক ভাবে সংরক্ষন করা বাঞ্ছনীয়। গ্লোব বায়োটেকের ব্রিফিং থেকে জানতে পারলাম এখন তারা ইঁদুরের উপর ভ্যাক্সিন ট্রায়াল দিবে।
(২) ভ্যাক্সিনের অ্যানিম্যাল ট্রায়াল:
এ ধরনের অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে অনেক ধরনের পশু ব্যবহার করা হয়, যেমন Rats, বানর অথবা ইঁদুর। অক্সফোর্ড এবং চায়না (SinoVac) তাদের ভ্যাক্সিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল অ্যানিম্যাল ট্রায়াল করেছিল বানরের উপর। অন্যদিকে আমেরিকার মর্ডানা তাদের mRNA ভ্যাক্সিনের কোন অ্যানিম্যাল ট্রায়াল না করেই সরাসরি মানুষের শরীরে পরীক্ষা করেছে, তার কারন হল তাদের ভ্যাক্সিনে কোন জীবিত বা নিস্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করা হয়নি।
প্রথাগত ভ্যাক্সিন তৈরীতে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল খুবই জরুরী। যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করা এই ট্রায়ালেই জানা যায় পশুর শরীরে ভ্যাক্সিন কতটা নিরাপদ এবং কতটা কার্যকরী। ভ্যাক্সিন দ্বারা ইমিউনাইজ্ড পশু কী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্ত? ভ্যাক্সিনের ডোজ-ডিপেনডেন্ট রেসপন্সও দেখা হয় এই ট্রায়ালে। এধরনের ট্রায়াল সময় সাপেক্ষ।
ড. আসিফ মাহমুদের দেয়া এক টিভি সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারলাম তাদের রয়েছে ৪ টি টার্গেট এবং ৩ টি রুট অর্থাৎ মোট ১২ টি কম্বিনেশন। এ ধরনের কম্বিনেশন নিয়ে অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে অনেকগুলো ইঁদুরের প্রয়োজন পরবে। সময়ও লাগবে অনেক। কেননা দিনের শেষে তাদেরকে দেখাতে হবে যে তাদের ভ্যাক্সিন (অন্তত ২ টি টার্গেট) ডোজ-ডিপেনডেন্ট ইমিউন রেসপন্স করে। তাদেরকে দেখাতে হবে যে তাদের ভ্যাক্সিন পর্যাপ্ত পরিমানে সঠিক এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম। এবং ঐ এন্টিবডি করোনা ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, তাদেরকে দেখাতে হবে যে ভ্যাক্সিন প্রয়োগে ইঁদুরের শরীরে টি-সেল রেসপন্সও হচ্ছে পর্যাপ্ত। এসব ফলাফল যথাযথ কন্ট্রোল এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে দেখাতে পারলেই গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাক্সিনকে মানুষের উপরে ট্রায়ালের অনুমাদন দেয়া যাবে। এটাই নিয়ম। বাংলাদেশেও একই নিয়ম অনুসরন করা হবে বলেই মনে করি।
এ ধরনের অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে এথিক্যাল পার্মিশন নেয়া থেকে শুরু করে গোটা পরীক্ষা শেষ করতে সাধারনত সময় লাগে ৩-৪ মাস। সে হিসেবে গ্লোব বায়োটেকের প্রস্তাবিত ‘কন্ট্রোল্ড অ্যানিম্যাল ট্রায়াল’ শেষ হতে পারে আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ।
তৃতীয় ধাপঃ Phase I হিউম্যান ট্রায়াল: ডোজ এবং সেইফ্টি চেক।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ট্রায়াল। এই ট্রায়ালে কমপক্ষে ৫০-১০০ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক এবং যারা কখনই করোনায় আক্রান্ত হয় নাই তাদের শরীরে ভ্যাক্সিনটি দেয়া হবে মাংসপেশীতে। সাধারনত ৩ ধরনের ডোজে (high, medium and low) ভ্যাক্সিন দেয়া হবে। তারপর খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কোন রিঅ্যাকশন হয় কী না। ভ্যাক্সিনের কারনে শরীরের সকল ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভ্যাক্সিন প্রয়োগের আগে এবং ৭, ১৪ এবং ২৮ দিন পরে রক্তের এন্টিবডি টাইটার এবং টি-সেল রেসপন্স দেখতে হবে। এ সব কিছুর ফলাফল যদি ভাল হয় এবং ভ্যাক্সিনে যদি তেমন খারাপ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত না হয় তাহলে ভ্যাক্সিনটিকে Phase II trial এর জন্য অনুমোদন দেয়া হবে। যদি এথিক্যাল পার্মিশন নেয়া থাকে এবং হেল্থি ভলান্টিয়ার সব প্রস্তুত থাকে তাহলে এই ধরনের ট্রায়াল ২ মাসের ভেতরই সম্পন্ন করা সম্ভব।
সুতরাং সেই বিচারে, গ্লোব বায়োটেক এ বছরের ডিসেম্বরের আগে কোনভাবেই ভ্যাক্সিনের Phase I ট্রায়াল শেষ করতে পারবে না।
চতুর্থ ধাপঃ Phase II এবং Phase III হিউম্যান ট্রায়াল।
(১) Phase II হিউম্যান ট্রায়াল: এই ট্রায়ালের মাধ্যমেই প্রমানিত হবে উৎপাদিত ভ্যাক্সিনটি প্রকৃতই করোনার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরী করতে পারে কী না। এক্ষেত্রে ৩০০-৫০০ জন বিভিন্ন বয়সের সুস্থ মানুষকে ভ্যাক্সিনটি দেয়া হবে এবং ২ মাস ধরে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। দেখা হবে তাদের শরীরে ভ্যাক্সিনটি ইমিউনিটি তৈরী করতে পারে কী না। এই ট্রায়ালে প্লাসিবো কন্ট্রোল গ্রুপও রাখতে হবে তুলনা করার জন্য।
সুতরাং সবকিছু ভালভাবে এগোলে গ্লোব বায়োটেক তাদের Phase II ট্রায়াল চালাতে পারে আগামী বছরের জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসের মধ্যে।
(২) Phase III হিউম্যান ট্রায়াল:
এটাই হচ্ছে একটা ভ্যাক্সিনের সর্বশেষ ট্রায়াল যা সর্ববৃহৎ ট্রায়ালও বটে। এই ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার মানুষকে। ভ্যাক্সিন দিয়ে তাদেরকে কমিউনিটিতে কোন প্রকার প্রতিরোধ ব্যাবস্থা ছাড়াই চলাফেরা করতে দেয়া হয়। এভাবে অন্তত ২/৩ মাস ধরে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং দেখা হয় ভ্যাক্সিন গ্রহিতাদের ভেতরে কয়জন করোনায় আক্রান্ত হয় এবং কন্ট্রোল গ্রুপের কয়জন করোনায় আক্রান্ত হয়। যদি দেখা যায় যে ভ্যাক্সিন দেয়াতে করোনা ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, তখই কেবল বলা যায় যে আবিস্কৃত ভ্যাক্সিনটি কার্যকরী। অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিনটি এখন Phase III ট্রায়াল চালাচ্ছে কমপক্ষে ৩ টা দেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের উপর। সেপ্টেম্বরে ওদের এই ট্রায়াল শেষ হবে। অ্যাস্ট্রাজেনিকা সেপ্টেম্বরের শেষেই যুক্তরাজ্যের জন্য তাদের প্রথম ব্যাচ ৩০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাক্সিন বানাবে পরে সরবরাহ করবে আরও ৭০ মিলিয়ন। এর পর ওরা ৪০০ মিলিয়ন ডোজ সরবরা করবে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৪০০ মিলিয়ন ডোজ দিবে ইউরোপে।
সবকিছু ঠিকমত চললে গ্লোব বায়োটেক তাদের Phase III ট্রায়াল শুরু করতে পারবে আগামী বছরের এপ্রিল বা মে মাস থেকে। কিন্তু ঐ সময়টাতে বাংলাদেশে সম্ভত তেমন কোন করোনা রোগীই থাকবে না। সুতরাং তাদের Phase III ট্রায়াল সম্পন্ন করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে অনেকটা সময় এবং নির্ভর করতে হবে অন্য দেশের উপর যেখানে করোনা ইনফেকশন বেশী। এ ধরনের সমস্যায় পরেছিল অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন। ওরা যখন Phase III ট্রায়াল শুরু করলো জুনের শেষে তখন যুক্তরাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেল অনেক। পরে অবশ্য ওরা ব্রাজিল এবং সাউথ আফ্রিকাতে ভ্যাক্সিন ট্রায়াল শুরু করে। তাই বলা যায়, গ্লোব বায়োটেকের Phase III ট্রায়াল আগামী বছরের আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের আগে শেষ করা সম্ভব নয়? অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। এর পরে তাদেরকে ভ্যাক্সিন প্রোডাকশনে যেতে হবে।
আগামী বছর জুনের ভেতরে মর্ডানা তাদের mRNA ভ্যাক্সিন বাজারে আনার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। চায়নাও তাদের ভ্যাকসিন আনতে চাচ্ছে খুব তারাতারী।
এই মহামারীর সময় গ্লোব বায়োটেক যে নিজ ইচ্ছায় ভ্যাক্সিন প্রোজেক্ট নিয়ে এগিয়েছে তার জন্য তারা অবশ্যই বাহবা পাওয়ার উপযোগী। সরকারের উচিৎ তাদেরকে সর্বাত্মক সহয়তা দেয়া। ভ্যাক্সিন আমাদের লাগবেই, শুধু করোনার জন্য নয়, আরও অনেক রোগের জন্যই লাগবে। সে ক্ষেত্রে তা যদি উৎপাদিত হয় নিজ দেশেই সেটা তো একটা বিড়াট ব্যাপার, দেশের জন্য সন্মানের ব্যাপার।
তবে, একটা কথা না বল্লেই নয়। গ্লোব বায়োটেকের দাবী যে তারা এই ডিসেম্বরেই নতুন ভ্যাক্সিন উৎপাদন করে ফেলবে তা সম্পূর্ন অবান্তর এবং অবাস্তব। কেন? আমি উপরে তা ব্যাক্ষ্যা করেছি। আগামী বছরের আগস্টের আগে যদি তারা বাজারে করোনা ভ্যাক্সিন আনতে পারে সেটা হবে সম্পূর্নই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
[Conflict of interest: মতামত সম্পূর্নই আমার নিজেস্ব। ড. আসিফ মাহমুদকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে চিনি না। গ্লোব বায়োটেকের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।]
লেখক: MBBS, MSc, Ph, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।