গেল সোমবার লাদাখে ঠিক কী ঘটেছিল তা নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ভারত একতরফাভাবে চীনের ওপর দোষ চাপালেও এখন নিজেদের কথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাপে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চীন চুক্তি ভঙ্গ করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডে কোনো দেশের সেনারা প্রবেশ করেনি। বরং ভারতীয় সেনারা চীনকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে। ফলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, চীনা সেনারা ভারতে প্রবেশ না করলে ভারতীয় সেনাদের হত্যা করলো কারা? তাহলে কী ভারতীয় সেনারাই চুক্তি ভঙ্গ করে চীনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়ায় সমালোচনা চলছে দেশটিতে।
তবে লাদাখে যাই ঘটুক ভারতের কিছু মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করেছে। যা ভারত-বাংলাদেশের চলমান বন্ধু সুলভ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার এমন অনাকাঙ্খিত প্রচারণার ফলে দেশের মানুষের মধ্যে ভারতের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে। কিন্তু সবকিছু জেনে-বুঝে শুক্রবার (২০ জুন) ভারতের দু’টি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে সংবাদ প্রকাশ করেছে।
ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। দুই দেশই বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম। বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত সরকার ও দেশটির বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জড়িত। তেমনি চীন সরকার ও দেশটির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জড়িত। দুই দেশই বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা করছে। কিন্তু দেশ দু’টি সম্প্রতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইবে এটা স্বাভাকি। তবে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করাই শ্রেয় বলে পরামর্শ বিশ্লেষকদের। এবং বাংলাদেশ সরকার নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারতের বহুমুখী বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাট বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। সরকারি হিসাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গড় বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ৩০০ কোটি ডলার। আর অবৈধ বাণিজ্য হিসাবে আনলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দ্বি-গুণ। ভারত তার মোট আমদানির মাত্র ২ শতাংশ আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৬ শতাংশ আসে ভারত থেকে।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি থাকলেও বাংলাদেশকে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেয় তারা। চলতি মাস পর্যন্ত চীনের বাজারে বাংলাদেশ তিন হাজারের বেশি পণ্যে শুল্ক ছাড় পেত। শুক্রবার (২০ জুন) নতুন করে চীন বাংলাদেশের আরও ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যেকে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। সবমিলিয়ে চীনের বাজারে এখন বাংলাদেশের ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের অনুমোদন দেয়া হল। এতে দেশটিতে ৩টি বাদে বাকি সব পণ্যই শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি পেলো যা দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে মোট রফতানি হওয়া পণ্যের ৯৭ শতাংশ।
চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয়ার পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে গাত্রদাহ শুরু হয়ছে। দেশটির প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার ‘লাদাখের পরে ঢাকাকে পাশে টানছে বেইজিং’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। খবরে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতির টাকা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয় চীনের। লাদাখে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত-সংঘর্ষে উত্তাপ ছড়ানোর পরে ফের নতুন উদ্যমে সে কাজে নেমেছে বেজিং। শুক্রবার বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা ঘোষণা করেছে তারা। তাতে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া অতিরিক্ত ৫১৬১টি পণ্যে শুল্ক না-নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে চিনে রফতানি হওয়া পণ্যের ৯৭ শতাংশকেই শুল্কমুক্তির সুবিধা দিল বেজিং। জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে নতুন সিদ্ধান্তটি কার্যকর হচ্ছে।
আনন্দবাজার বলেছে, ‘বাংলাদেশ একমাত্র প্রতিবেশী দেশ, নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও যাদের সঙ্গে ভারতের একটা পরীক্ষিত সুসম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা-মলদ্বীপ থেকে উত্তরে নেপাল-ভুটান, কারও সঙ্গেই আর আগের উষ্ণ সম্পর্ক নেই ভারতের। কূটনীতিকরা বলছেন, এই পরিস্থিতির পিছনে চীনের হাত স্পষ্ট। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একঘরে করে ফেলার কৌশল বাস্তবায়িত করছে বেজিং। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ তাদের নিশানা। এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন তারা লগ্নি করেছে, দেশের গ্রামীণ বাজারগুলিতেও পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হচ্ছে চীনা বণিকেরা।’
শুক্রবার ভারতের আরেক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্য জি নিউজ অত্যান্ত নোংরাভাবে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করে সংবাদ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটি শিরোনাম করেছে ‘ভারতকে চাপে ফেলতে বাংলাদেশকে ‘খয়রাতি’ চীনের! নেপালের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টায় বেজিং।’
খবরে বলা হয়েছে, ‘নেপালের পর বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে পড়শিদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত ৯৭ শতাংশ পণ্যকেই শুল্কমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং। শি জিনপিং সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ঢাকা। সূত্রের খবর, বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত হওয়ায় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছল।
লাদাখে চীনা আগ্রাসনের মোকাবিলা করছে ভারত সরকার। পশ্চিম দিকে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই চীনের কব্জায়। অতিসম্প্রতি আবার নেপালও ভারতীয় ভূখণ্ডের একাংশ নিজেদের দাবি করে মানচিত্র সংশোধন করেছে। শ্রীলঙ্কা ও ভূটানের সঙ্গেও আগের মতো সম্পর্ক নেই নয়াদিল্লির। মলদ্বীপে কিছুটা হলে জমি পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে। এহেন প্রেক্ষাপটে ভারতের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশও আর্থিক সুবিধা দিয়ে কূটনৈতিক খেলায় নেমে পড়ল বেজিং।’
তবে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশকে কটাক্ষ করলেও বাংলাদেশ সঠিক অবস্থানেই আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ সরকার চুপ থাকার নীতিই অবলম্বন করেছে এবং এটি সময়োপযোগী কৌশল।
সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভারত চাইছে লাদাখের ঘটনায় বাংলাদেশ, নেপাল এমনকি পাকিস্তানও চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুক। কিন্তু তা হয়নি। এটি বিজিপি সরকারকে অবাক করেছে। জানতে পেরেছি, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর নাকি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশ কেন ভারতকে সমর্থন করে কথা বলছে না? ভারত এ ব্যাপারে চাপ দিতে পারে। কিন্তু আমাদের শক্ত অবস্থানে থেকে চুপ থাকার নীতি অবলম্বন করতে হবে। আমাদের কোনো পক্ষই সমর্থন করা ঠিক হবে না।’
চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সংঘাত যদি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়ায় তাহলে সরাসরি কোনো দেশের পক্ষে অংশ নিতে বাংলাদেশকে চাপে পড়তে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন)। তারা বলছে, এ ধরনের একটা চাপ গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ওপর আছে।
অন্যদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে চীন এবং ভারত, উভয় দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। দুই দেশের মধ্যে যদি যুদ্ধ হয়, তখন বাংলাদেশের ওপর সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়ার জন্য চাপ বাড়বে কিনা এমন বিশ্লেষণমূক মন্তব্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জটিল পরিস্থিতিতে পড়বে।
খবরে বলা হয়েছে, এ ধরনের একটা চাপ গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ওপর আছে। যেমন ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছিলেন যে চীনের সাহায্যে তারা চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব যখন বাংলাদেশ চীনের কাছে দেয়, তখন চীন সেটি গ্রহণ করেছিল। এই বন্দর নির্মাণে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং জাপানের চাপের মুখে বাংলাদেশকে সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে হয়। পরে বাংলাদেশ জাপানের সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণ করছে।
ভারত বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় চেষ্টা করেছে সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখার। ভারতের এমন আচরণের কারণে বাংলাদেশের সরকারকে অনেক সময় অভ্যন্তরীণ চাপেও পড়তে হয়। লাদাখের ঘটনার পর বাংলাদেশ যেন ভারতের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয় এজন্য চাপ সৃষ্টি করতেই ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষমূলক প্রচারণা করছে। তবে কোনো চাপেই বাংলাদেশকে তার নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে আসা উচিৎ হবে না বলে মত বিশ্লেষকদের।
সূত্র: সময় টিভি