রুদ্র আহনাফ
অনেকেই বলেন বিদ্রোহ আবার কেউ বলেন প্রতিবাদ এভাবে ১১ বছর কেটে গেলো তবুও বিতর্কের শেষ হয়নি। তাহলে যারা ফাঁসিতে ঝুলেছেন আর এখনও কারাগারের অন্ধকার প্রকাষ্ঠে দিন কাটাচ্ছেন তাদের কি অপরাধ? আর সেদিন ঘাতকের গুলিতে যে ৭৪ জনকে শহীদ করা হয়েছিলো তাদেরও বা কি অপরাধ ছিলো?
এসব প্রশ্ন নিয়ে সকাল থেকে পাঠক প্রিয় পত্রিকাগুলোতে একটু ঢু মারলাম। না কোথাও এই বিতর্কের শেষ দেখলাম না। তবে এটাকে বিদ্রোহ বলতে নারাজ তৎকালীন বিডিআর হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের কন্যা ফাবলিহা বুশরা। বিবিসির সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, আমরা যারা ভেতরে ছিলাম আমরা কোনো বিদ্রোহ দেখিনি। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দেখিনি। আমরা মানুষ মারার পর তাদের উল্লাস দেখেছি। আমরা মানুষকে নির্যাতন করা দেখেছি। ছোট ছোট বাচ্চাকে গিয়ে গালিগালাজ করা মহিলাদের গায়ে হাত দেয়া এটা কী ধরনের প্রতিবাদ? আমি এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না, আমরা কেউই এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না। কারনেজ বলতে চাই। আমি এটাকে ম্যাসাকার বলতে চাই।
২০০৯ সালের আজকের এই দিনে তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে সংঘটিত হয় বর্বরোচিত এক হত্যাকাণ্ড। সেদিন শহীদ হয় বাংলাদেশের ৫৭ জন সেনা অফিসার। ১৯৭১ এ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও এতজন সেনা অফিসার শহীদ হননি। দুর্ঘটনাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে মোট ৫৫ জন অফিসার শহীদ হয়েছিলেন। শুধু আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন? বিশ্বের ইতিহাসে একসাথে এতজন উচ্চ পদস্থ সেনা অফিসার নিহত হওয়ার মত করুণ ইতিহাস পাওয়া যায় না।
২৫ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় সেই কালো অধ্যায়ের। ওই দিন দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিপথগামী বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। এদের মধ্যে একজন বিডিআর মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে, তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় তখন এক ভীতিকর বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি হয়। এসময় বিদ্রোহীরা পিলখানার চারটি প্রবেশ গেট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশে-পাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়ে মেধাবী সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর ক্ষান্ত হয় ঘাতকেরা। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। ৩৬ ঘণ্টার সেই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি লুটিয়ে পড়ে এই স্বাধীন বাংলার মাটিতেই।
বিদ্রোহীদের হত্যাযজ্ঞের দায়ে বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। এরপর শুরু হয় কথিত বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোষাক, লোগো, সাংগঠনিক কাঠামো, পদোন্নতি ইত্যাদি পুনর্গঠনের নামে তছনছ করা হয়। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিডিআর বিদ্রোহের আইন। বর্ডার গার্ড আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা রাখা হয় মৃত্যুদণ্ড।
২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় দেয় আদালত। রায় ঘোষণার দুই বছর পর গত ৮ জানুয়ারি ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৫২ পাতার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা পিলখানা হত্যা মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড ও সাজা বহাল রাখেন।
শুধুই কি পিলখানার এই হত্যাযজ্ঞ? না! সেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতিতে লগি-বৈঠা দিয়ে বর্বরতার যাত্রা শুরু করে আজ অবধি চলছেই। মানবাধিকার লুন্ঠন, গণহত্যা, গুম, ধর্ষণ, গণতন্ত্র হত্যা, কিংবা জনগণের বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার সে অশুভ প্রতিযোগীতার বিরুদ্ধে আর কাউকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি।
লগি-বৈঠা দিয়ে বর্বর হত্যাকান্ডের পর ১/১১ এর বিতর্কিত সেনা সমর্থিত সরকার গঠন করে ২০০৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর ‘হাইব্রিড’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। জনগণের প্রত্যাশা কে ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের উদাসীনতায় নাকি প্রত্যক্ষ মদদেই পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয় সেটাও আজ ধোঁয়াশায়।
এসব হত্যকান্ডের মাধ্যমে মূলত দেশের সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে ক্ষমতায় থাকার চক্রান্ত করা হয়েছিলো। এরপর সাভারে রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে ১১শ’র বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ছিল শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। যার পেছনে ক্ষমতানসীন সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী স্বার্থান্বেষী চক্রের যোগসূত্র প্রমাণিত হয়েছে।
তারপর থেকে টিঁপাইমুখ বাঁধ, পার্বত্য এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার, এশিয়ান হাইওয়ে এবং টাস্কফোর্সসহ স্বার্থপর প্রতিবেশী ভারতের সাথে নানা ধরনের গোপন চুক্তি আজও বাংলাদেশ ভুলেনি।
ওপাড়ের ইশারায় কথিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের নামে প্রহসন করে আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় দেয়া হয়। রায়ের প্রতিবাদে যখন সারাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা রাজপথে নেমে এসেছিল তখন তাদের উপর যে বর্বর গণহত্যা চালানো হয়েছিল বাংলার প্রতিটি রাজপথ এখনো তার সাক্ষ্য বহন করে।
এরপর ৫ই মে রাতের আধারে হেফাজত ইসলামী এর নেতা-কর্মীদের ওপর নৃশংস ভাবে যে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল বাংলার মানুষ আজও তার সাক্ষী হয়ে আছে। এ সময় এই নৃশংস হত্যাকান্ড সরাসরি সম্প্রচার করায় জনপ্রিয় দিগন্ত ও ইসলামী টিভি বন্ধ করে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্তও জনগণের চোখে ভেসে বেড়ায়।
শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয় দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজ যখন নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে লেলিয়ে দেওয়া হলো হাতুড়ি বাহিনী। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবি করায় জাতীয় সংসদ থেকে তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেয়া হয়। রক্তাক্ত হয় শাহবাগ, শহীদ মিনারসহ সারাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এতবেশি রক্তাক্ত হয়নি। গ্রেফতার করা হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। গুম করা হয় আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের। ভাংচুর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন।
এরপর বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় থাকা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে চালিয়ে দেয়া হলো গাড়ি। নিহত হলো দুই কিশোর শিক্ষার্থী। কিন্তু এ নিয়ে কোন প্রকার দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো মন্ত্রী মশাইয়ের হাস্যরসে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নেমে আসলো রাজপথে। শুরু হলো নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন। রাজধানীর ঝিগাতলাসহ রাজধানীর অলিগলিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হলো দলান্ধ পুলিশ ও বর্বর হেলমেট বাহিনী। ধানমণ্ডিস্থ আওয়ামী লীগ আফিসে স্কুল ছাত্রীদের আটক রেখে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। এরপর ভারত বিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়ার কারনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মেধাবী ছাত্র আবরারকে।
এভাবে বলতে থাকলে হাজার ইতিহাস বলা যাবে। কিন্তু এসব ইতিহাসের সাক্ষ্য কি আমরা হতে পারবো? আমাদের কলমের কালিতে আজ বুশরাদের পিলখানার সেই ৩৬ ঘণ্টার গল্প উঠে আসেনা। এতো সব কর্মযজ্ঞের পরে ক্লান্ত প্রাণ নিয়ে বর্ষপূর্তিতে মেতে উঠি। ভাষা শহীদদের স্থানে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবির ঠাঁই হয়। এভাবে হয়তো একদিন ৩৬ ঘন্টার ইতিহাসও আমরা ভুলে যাবো। ভুলে যাবো হাজারও জুলুমের রোমহর্ষক ইতিহাস।