গত ২৩ জানুয়ারি একটি খবর ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, BCL men at it again, torture 4 at DU dorm/ They do it after branding them as shibir activists, hand them over to cops who later release them.. অনুবাদ: আবার সেই কাজে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে ৪ জন ছাত্রকে নির্যাতন/ ওদেরকে শিবিরের লেবেল দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে এবং পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। খবরের বিবরণে প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢাকা বিশব্বিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থীকে ৩ ঘণ্টা ধরে পিটিয়েছে এবং মঙ্গলবার সকাল হওয়ার কিছু আগে তাদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের গায়ে শিবিরের লেবেল এঁটে দিয়েছে এবং রাত সাড়ে ৩টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের একটি টিমের উপস্থিতিতে তাদেরকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের সাথে শিবিরের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু বলেনি। সারা মুখমন্ডলে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় নির্যাতিত ৪ জনের একজন মুকিম চৌধুরী পর দিনই বিকাল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বলেন যে, এই হামলার বিচার তিনি যতক্ষণ না পাচ্ছেন ততক্ষণ তিনি বসে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন বিভাগের ছাত্র মুকিম চৌধুরী বলেন, তিনি কোনদিন শিবির সমর্থন করেননি। তিনি স্বয়ং ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। মুকিম ছাড়া আর যে ২ জনকে নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয় তারা হলেন ইসলামী ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মিনহাজ উদ্দীন এবং আরবী বিভাগের ছাত্র আফসার উদ্দিন।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে গত ৭ অক্টোবর ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করার পরে ৩ মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন ছাত্রকে অনুরূপভাবে পেটানো হলো। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার আগে তাকে শিবির কর্মী বলে তকমা এঁটে দেওয়া হয়। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হোসেন বলেন যে, গত ২৩ তারিখে বেলা আড়াইটার দিকে নির্যাতিত ছাত্রদেরকে তাদের অভিভাবকদের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে সানোয়ার এবং আফসারের পিতা ডেইলি স্টারের প্রতিনিধিকে বলেন যে, তারা জানেন না যে তাদের সন্তানেরা কোথায় আছে। তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত অপর ছাত্র মিনহাজ বলেন যে, তিনি তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন।
দুই
ঘটনার বর্ণনা দিতে প্রথমে মুকিম বলেন, ‘সোমবার রাত ১১টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্রলীগের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন তাকে ডাকেন এবং হলের গেস্ট রুমে যেতে বলেন। গেস্ট রুমে পৌঁছানোর পর আমি সেখানে দেখতে পাই হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত, জেনারেল সেক্রেটারি তৌফিকুল ইসলাম, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের যুগ্ম জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি আমীর হামজা এবং আনোয়ার হোসেনকে। এর পর ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে হল ইউনিয়নের অফিসে নিয়ে যায়। তার পর তারা সানোয়ারকেও হল ইউনিয়ন অফিসে ডাকে। সানোয়ার সেখানে পৌঁছালে আনোয়ার আমাদেরকে একটি ম্যাসেঞ্জার কথোপকথনে স্ক্রিনশর্ট দেখায় এবং বলে যে আমরা যে ছাত্র শিবির করি এই স্ক্রিন শর্টটি হলো তার প্রমাণ।
এর পর আমি শিবির এই বলে আমাকে গালাগালি করা হয় এবং আমার মুখমন্ডলে কিল ঘুষি মারা হয় এবং তার পর আমাকে লাথি মারা হয়। মার খেতে খেতেই আমি বুঝতে পারি যে স্ক্রিনশর্টটি ভুয়া। তারপর মুকিম বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য মাহফুজুর রহমান ইমন, আমীর হামজা, আব্বাসী এবং হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল উদ্দিন রানা তাদেরকে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প এবং তার দিয়ে পেটাতে থাকে। মুকিম বলেন যে ছাত্রলীগের নেতারা প্রধানত তাকে হাতে এবং হাঁটুতে মারতে থাকে। রাত দেড়টার দিকে তারা আমাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তারা মিনহাজ উদ্দীন এবং আফসার উদ্দীনকে আগে থেকেই ডেকে এনেছিল। সেখানে তারা আমাকে (মুকিম) এবং আফসার উদ্দীনকে পেটাতে শুরু করে। মুকিম অভিযোগ করেন যে, হলের হাউজ টিচার বিল্লাল হোসেন রাত আড়াইটার দিকে আসেন। কিন্তু তিনি ছাত্রলীগের মারধর বন্ধ করার কোন কিছু না করেই চলে যান। এর পর হাউজ টিচার প্রক্টর অফিস এবং পুলিশকে বিষয়টি জানান। ডেইলি স্টার প্রতিনিধি জানান যে, তিনি প্রফেসর বিল্লালকে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন।
শাহবাগ পুলিশ সানোয়ার এবং তাকে (মুকিম) কে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। তারপর তাদেরকে থানায় আনা হয়। ডেইলি স্টারের প্রতিনিধির কাছে মিনহাজও মুকিমের মতোই ঘটনার বর্ণনা দেন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েক জন ছাত্রলীগ নেতা স্বীকার করেন যে, তারা ৪ জন ছাত্রকে পিটিয়েছেন। ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘হল ইউনিয়নের সদস্যরা আমাকে বলেন যে তারা শিবিরের একজন সদস্যকে ধরেছেন। তারা মুকিমের কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশর্ট আমাকে দেখান, যেটি প্রমাণ করে যে, সে শিবিরের লোক। মুকিম বা অন্য ৩ জনকে মারধরের খবর তিনি জানেন না। তিনি বরং অন্যদেরকে বলেন যে মুকিমকে পুলিশে সোপর্দ করা হোক। তারপর চেষ্টা করা সত্তে¡ও ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর গোলাম রব্বানী বলেন যে, ঐ ছাত্ররা শৃঙ্খলা বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত আছেন কিনা সেটি খতিয়ে দেখার জন্য তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তিন
ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসী কারবার নতুন কোনো ঘটনা নয়। ডেইলি স্টারে আলোচ্য রিপোর্ট মোতাবেক গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজয় ৭১’ হলের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ সদস্য রানা আকন্দকে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয়। তার অপরাধ, সে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে হাজির হয়নি।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সলিমুল্লাহ হল ছাত্রলীগের নেতারা এহসান রফিক নামক ঐ হলের একজন আবাসিক ছাত্রকে শিবির সন্দেহে নির্মমভাবে প্রহার করে।
২২ জানুয়ারি একই বিষয়ে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ যে রিপোর্ট করেছে তার শিরোনাম, ঢাবিতে ৪ শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন। ছাত্রলীগ নেতা বলেন, তাদেরকে স্বীকার করাতে পারিনি। ইনকিলাবের রিপোর্ট মোতাবেক ঐ ৪ জনকে লাথি, চড় এবং হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়। মার সহ্য করতে না পেরে তারা মাটিতে পরে যান। তাদেরকে যারা সবচেয়ে বেশি মেরেছে তাদের অন্যতম আমীর হামজা বলে, তাদের নিকট থেকে শিবির সংশ্লিষ্ট দুটি বই পেয়েছি। কিন্তু বই দুটির নাম কী সেটা বলতে পারেননি। এর আগে এই আমীর হামজা চাঁদা চেয়ে এক ব্যবসায়ীকে মারধর করে। সে একবার ছিনতাই কালেও ধরা পড়ে বলে ইনকিলাবের রিপোর্টে প্রকাশ। দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্ট মোতাবেক সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রলীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন মুখ ফসকে বলেন, ‘শালাদের অনেক মেরেছি। কিন্তু একটাকেও স্বীকার করাতে পারিনি। একজনের নামও বলেনি।’ ইনকিলাব, ২৩ জানুয়ারি, ২০২০)।
প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেন, ‘যদি ঐ শিক্ষার্থীদেরকে রাষ্ট্রবিরোধী ও শৃঙ্খলাবিরোধী অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
চার
এ সম্পর্কে খুব কম কথায় সবচেয়ে সঠিক এবং আইনানুগ মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. আসিফ নজরুল। তিনি সোজা সাপটা মন্তব্য করেছেন, ‘শিবির করা অপরাধ নয়। বরং শিবির সন্দেহে মারধর করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের শিবির সন্দেহে মারার যে কাজ শুরু করেছে ছাত্রলীগ, এটাই তো সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কাজ। অন্য দল করলেই তাকে প্রহার করতে হবে সেই অধিকার তাদের কে দিয়েছে?’ তিনি বলেন, এই দেশটি তো আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নয়। আমার ওপর হামলা করেও বলা হয়েছে, আমি শিবির। তিনি বলেন, আর নীরব থাকলে চলবে না। ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। রুখে না দাঁড়ালে ছাত্রলীগের হাতে মার খেতেই থাকবে ছাত্রসমাজ।
ছাত্রলীগকে ভার্সিটিতে পুলিশী দায়িত্ব কে দিয়েছে? যখন তারা হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ব্যবস্থার মতো সাধারণ ছাত্রদের গেস্ট রুমে তলব করে পেটায় তখন পুলিশ নীরব থাকে কেন? প্রক্টর বলেন, ঐ মার খাওয়া ছাত্ররা যদি রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকে বা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তাকে বলতে হবে কোন আইনে কোন অধিকারে ছাত্রলীগ গেস্ট রুমে অন্যদের ডেকে পাঠায়? তার বিরুদ্ধে তিনি কী অ্যাকশন নেবেন? এই যে ৪ জনকে রড এবং হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হল তার জন্য তাদেরকে তিনি পুলিশে দিলেন না কেন? শুধু প্রক্টর নয়, ভিসিকে জবাব দিতে হবে, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন, বিশেষ করে ইসলামী সংগঠন করা কি অপরাধ? মারধর চলাকালীন হাউজ টিচার এসেছিলেন। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন কেন? ডেইলি স্টারের মতে (২৪-০১-২০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে একটি অপবাদ দেওয়া এবং ফ্যাসিস্ট কায়দায় তাদের দমন করার ঐতিহ্য স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাসিস্টদের অবসান ঘটিয়ে শুধু একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আবরার ফাহাদসহ আর কতজনের রক্ত চাই?
মোবায়েদুর রহমান (ইনকিলাব)