অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
একাদশ সংসদ নির্বাচনে গায়েবি ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এমপিরা শপথ গ্রহণের পর সোমবার সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনা। নতুন সরকারের মন্ত্রিপরিষদে কারা থাকছেন রোববার তাদের নাম প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। একই সঙ্গে কাকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন মন্ত্রিসভাকে বড় ধরণের চমক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, এবার মন্ত্রিসভা থেকে বিতর্কিতদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে। ক্লিন ইমেজ সম্পন্ন লোকদেরকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
সরকারের নবগঠিত মন্ত্রিসভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী এবং ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারকে দেয়া হয়েছে শিল্পমন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। এই দুইজনই নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে মহা আতঙ্কের মূর্তপ্রতীক। কামাল মজুমদার মিরপুর-কাফরুল এলাকায় সন্ত্রাসের গড ফাদার ও গোলাম দস্তগীর গাজী সাধারণ মানুষের জমি দখলকারী হিসেবে পরিচিত। অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য তারা উভয়ই একাধিকবার গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গোলাম দস্তগীর গাজী তার নির্বাচনী এলাকায় শত শত বিঘা জমির মালিক হন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেশ কয়েকটি গ্রামে এখন গাজীর মালিকানাধীন জমি ছাড়া আর কারও জমি নেই। এসব গ্রামের পুরনো বাসিন্দাদেরকে তিনি জোর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। জমি দখল নিয়ে মামলাও হয়েছে। দখলের শিকার ভুক্তভোগীরা বিচার দাবি করে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করেছেন। জেলা প্রশাসকের কাছে দিয়েছেন স্মারকলিপি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাই রূপগঞ্জের বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছেন, গাজী জমি চাইলে ছেড়ে দিতে হবে।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রূপসী খাদুন এলাকায় বিশাল জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ‘গাজী নগর’। এই এলাকায় কেউ জমি কিনতে পারবেন না বলে অলিখিত ঘোষণাও দেয়া আছে। কথিত গাজী নগরের সীমানা দেয়ালে পুরো এলাকার নকশা আঁকা। যেখানে বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- গাজী সাহেবের পুকুর, গাজী স্টাফ কোয়ার্টার, গাজী অফিসার্স কোয়ার্টার ইত্যাদি। বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে ওই জায়গায় থাকা বিল ও জলাশয়ের অবস্থানও গাজীর সম্পত্তি বলে দেখানো হয়েছে। উপজেলার খাদুন, রূপসী ও বরপা এলাকায় কয়েকশ বিঘা জমি এমপির দখলে। অভিযোগ, এসব জমির অর্ধেকই জবরদখল করা।
এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী শুধু মানুষের জমি দখলই করে না। এই এলাকায় কেউ গাজীর সম্মতি ছাড়া জমি কেনাবেচা করতে পারেন না। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে আগাম সব বর্ণনা গাজীর নিয়োগকৃত লোকজনকে জানাতে হয়। যে কারণে রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্তাব্যক্তিরা এমন বেআইনি কর্মকাণ্ডকে নিয়মে পরিণত করেছেন। তাই বেআইনি হলেও নতুন নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় কেউ জমি কিনতে চাইলে জমির বিস্তারিত আগেই এমপির লোকজনকে জানাতে হয়। তা না হলে জমি রেজিস্ট্রি হয় না। কোনো দলিল লেখকও জমির দলিল লিখতে রাজি হন না। রেজিস্ট্রি অফিসে এমন জিম্মিদশা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
এছাড়া, রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় মার্কেটের নামে স্টেডিয়ামের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে নিয়েছেন গাজী গোলাম দস্তগীর। মার্কেটের নাম ‘নীলা মার্কেট’। প্রকাশ্যে মার্কেটের সর্বেসর্বা রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা। এলাকাবাসী বলছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রক মানে আসল দখলদার হলেন এমপি। এ জাতীয় দখলের পরও নীরব রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই সুযোগে গোটা এলাকা এখন এমপি এবং তাঁর সমর্থক দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর বেআইনি কর্মকাণ্ডের ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত অকার্যকর এবং নিজ দলীয় নেতাকর্মীরাও কোণঠাসা।
এলাকাবাসীর কাছে নীলা মার্কেট ‘গাজীর লোকদের সাম্রাজ্য’ নামে পরিচিত। এ সাম্রাজ্যে রয়েছে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট, কয়েক শ দোকানপাট, রেন্ট-এ-কারের টার্মিনাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানা, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। সরকারি সিদ্ধান্তে পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বিচারপতিসহ বিভিন্ন মহলের অনেকে প্লট পেয়েছেন। অনাগত প্রজন্মের জন্য সেই প্রকল্পে বিশাল জায়গা বরাদ্দ রাখা হয় স্টেডিয়ামের জন্য। কিন্তু রূপগঞ্জের জায়গাজমি দখলের রেকর্ড স্থাপনকারী এমপির নজর থেকে সেই স্টেডিয়ামের জায়গাটিও রক্ষা পায়নি। অনেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিষয়টি জানলেও এমপি গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটনের জন্য বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন গোলাম দস্তগীর। প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা ও সেবনসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করে না। গাজীর এসব কার্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ সাধারণ মানুষ এবার গাজীর পক্ষে ছিলেন না।
গাজী তার মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল ও বেরাইদ থেকে লোক নিয়ে মানববন্ধন করেছেন। রুপগঞ্জ থেকে মানববন্ধন করে এসে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছিলেন, স্থানীয়রা গাজীর পক্ষে নেই। জমিদখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। শেখ হাসিনাকে জনমর্থন দেখানোর জন্য ভাড়া করে আমাদের নিয়ে মানববন্ধন করেছে।
এরপর, ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের কথা আর বিস্তারিত বলার দরকার নেই। একবাক্যে তিনি সবার কাছে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। মিরপুর এলাকায় তিনি দখলবাণিজ্য করার জন্য বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে মিরপুর এলাকার নামিদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিনি মোটা অংকের চাঁদা তুলে থাকেন। শিক্ষক, সাংবাদিক ও পোশাক শ্রমিকসহ এমন কোনো শ্রেণি পেশার লোক নেই যারা এমপি কামাল মজুমদারের হাতে লাঞ্চিত হননি। এমনকি তার মালিকানাধীন মোহনা টিভির একাধিক নারী কর্মী তার হয়রানির শিকার হয়েছেন। মান-ইজ্জত ও জীবনের ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেননি। এক কথায় বলা যায়-গোটা মিরপুর অঞ্চলে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন কামাল মজুমদার। এমন একজন ব্যক্তিকেই মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এদিকে,গোলাম দস্তগীর ও কামাল মজুমদারের নাম মন্ত্রীদের তালিকায় দেখার পরই দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। জমিদখলকারী ও সন্ত্রাসীকে মন্ত্রীসভায় জায়গা দিয়ে শেখ হাসিনা কী চমক দেখালেন এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।