ডঃ মুহাম্মাদ এহছানুল হক
জিডিপি হলো একটা দেশের প্রোডাকশন ক্যাপাসিটির একটা অর্থনৈতিক সুচক। ধনী দেশগুলোর জিডিপি খুব ‘উচ্চ’। কোন দেশ দারিদ্রতা থেকে বের হয়ে ধনী হয়ে উঠবে কিনা তা মোটাদাগে নির্ভর করে জিডিপির বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির (GDP growth rate) উপরে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবছর জিডিপি কত শতাংশ বেশী। জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, মুদ্রাস্ফীতির হার ইত্যাদির চেয়ে বেশী হয় তাহলে একটি দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতিগুলোর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫-৮%।
আওয়ামীলীগের দাবীঃ
আওয়ামীলীগ দাবী করছে তারা দেশকে উন্নয়নে ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে তারা এর বিপরীতে দেখাচ্ছে। আসুন আমরা ডাটা দেখি। উপরের চার্টটি ওয়ার্লব্যাংকের ন্যাশনাল একাউন্ট ডাটাবেস থেকে নেয়া হয়েছে যেখানে ১৯৬১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে।
আইউব খানের আমল:
আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের ভুখন্ডটি জানা ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী জিডিপির গ্রোথ দেখেছে ১৯৬৪ সালে আইউব খানের শাসনামলে, ১০.৯৫%। ২০ বছর আগেও বাংলাদেশের ভারী শিল্পখাতে বড় বড় যত কলকারখানা আমরা দেখতে পেতাম তার প্রায় সবগুলোই ছিল এই আইউব খানের শাসনামলে করা। রাস্তাঘাটেরও একটা বড় অংশের ম্যাপিং ও পাকাকরন হয়েছিল এই আমলে। কি, সেই আমলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি তাহলে সেন্স মেক করছে তো!
মুজিবের আমল:
আমরা দেখি বাংলাদেশের জিডিপি সর্বনিম্ন ছিল ১৯৭২এ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেই, -১৩.৯৭%। যুদ্ধাবস্থার কারনে এমনটা হয়েছিল। সর্বোচ্চ জিডিপি ছিল ১৯৭৪এ, ৯.৫৯%। এটি মুলত কোন শিল্প বা ব্যবসাবানিজ্যের প্রসারের কারনে ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আবেগের চর্চার কারনে আন্তর্জাতিক ত্রান সহায়তার সয়লাব বয়ে যায় দেশে। আর তাই জিডিপি বেড়ে গিয়েছিল। এটি কোন সাসটেইনেবল পরিবর্তন ছিল না, বরং ত্রাণের টাকার বিপরীতে একটা বেলুনের মত ফুলে উঠেছিল জিডিপি। বিপরীতে এই ত্রানের টাকার প্রবাহ দেখে আওয়ামীলীগের আচরন হয়ে উঠেছিল সোমালিয়ান জলদুস্যুদের মত। নিজে নিজেরা কামড়াকামড়ি করে পুরো দেশকে অস্থির করে তুলেছিল। এর জের ধরে দেশ পেয়েছে ৭৫ এর হত্যাকান্ড।
জিয়ার আমল:
জিয়া ভিখারী বাংলাদেশের পরিবর্তে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। জিয়া এসে ৭৫ এ জিডিপি পেয়েছিলেন -৪.০৮%। তিনি এটাকে উন্নীত করেছিলেন ৯.৫৯%। এসময় বিদেশী সাহায্যের পাশাপাশি জিয়া মানুষকে কাজ করতে উতসাহিত করেছিলেন। যে কারনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির প্রতীক কৃষক বান্ধব ধানের শীষ। তাছাড়া জিয়া প্রথম জনগনে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিলেন। এনমনকি রাজনৈতিকভাবেও বহু দলীয় রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছিলেন তিনি। এর জের ধরে জিয়াকে হত্যা করা হয় ১৯৮১।
এরশাদের আমল:
আমাদের প্লেয়ার এরশাদ সাহেব জিডিপি পেয়েছিলেন ৪.৮০%। মোটাদাগে তাঁর শাসনামলে দেশের জিডিপি ২-৪% এর মধ্যেই ঘোরাঘুরি করেছে। এর মুল কারন ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশে ব্যবসা বানিজ্য কোন কিছুর প্রসার না ঘটা এবং বৈদেশিক অনুদানের পরিমান কমে আসা। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোটায় নেমে না আসার কারন হলো গার্মেন্টস কেন্দ্রিক কিছু প্রোডাকশন শুরু হওয়া। স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয় ৯০তে। বাংলাদেশ আবার ফিরে পায় বহুদলীয় গনতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ।
গনতান্ত্রিক বিএনপির প্রথম শাসন আমল:
স্বৈরাচারের পতনের পরই জিডিপি বাড়ার সুযোগ পায় এবং আমরা দেখি, ১৯৯১তে ৩.৪৯%এ শুরু করে বিএনপি এই পুরো শাসনামলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি রেখেছিল প্রায় ৫-৫.৫% এর ঘরে। এসময় ইন্টারনেটের সুচনা হলেও, বিএনপি জিডিপি উন্নয়নে একে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়।
আওয়ামীলীগের প্রথম শাসন আমল:
আওয়ামীলীগ তাদের ১৯৯৬ এর সরকার শুরু করে জিডিপি ৪.৫২% নিয়ে। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় কিছুটা কমে এসেছিল। ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামীলীগের এই শাসনামলে জিডিপি প্রায় ৪.৫০-৫% এর মধ্যে ছিল। এসময়ে মোবাইল নেটওয়ার্কের ইন্ট্রোডাকশনকেও কাজে লাগাতে পারেনি আওয়ামীলীগ।
বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোটের প্রথম শাসন আমল:
নতুন সরকারের প্রথম বছরে আওয়ামীলীগের শাসনের জের হিসেবে ২০০২ এ জিডিপি ছিল ৩.৮৩। বিপরীতে চারদলীয় জোট বছর বছর জিডিপির উন্নয়ন ঘটিয়ে ২০০৬ এ পৌছে যায় ৬.৬৭% জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। আর ২০০৭ এ এসরকারের কর্মকান্ডের জেরেই জিডিপি আবার ৭.০৬% এর ঘরে পৌছে যায়। যা সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ের সময়ে এসে কিছুটা কমে ৫ এর ঘরে নেমে এসেছিল। বিএনপি-জামায়াতের জোটের প্রবৃদ্ধির এই সাফল্য মুলত এর আগের ৩০ বছরের তুলনায় নজীরবিহীন ছিল। এক্ষেত্রে মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রসার, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ইত্যাদির প্রভাব ছিল। কিন্তু বিদ্যুত সেক্টরে সরকারের অমনোযোগের কারনে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে সমানভাবে বিদ্যুত উৎপাদন বাড়েনি। যদিও পরবর্তী নির্বাচনের ইশতেহারে বিদ্যুতখাতে বড় ধরনের উতপাদনের প্ল্যান তাদের ছিল।
আওয়ামীলিগের মহাজোটের প্রথম শাসন আমল:
মোবাইল ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইন মার্কেট এবং ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে গ্লোবালাইজেশনের যে স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছে এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জিডিপি উত্তোরোত্তর বাড়ার কথা। অন্যদিকে দেশের একটা বিরাট অংশ শিশু বয়স থেকে কেবল মাত্র তরুন বয়সে পৌছেছে প্রত্যেকে কাজের উপযোগী দুটি হাত নিয়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আওয়ামীলীগের মহাজোট ২০১০-২০১৪ প্রথম শাসনামলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারে আগের সরকারের চেয়েও বড় অংকে পিছিয়ে ছিল। পুরো সময়টাতে জিডিপির ঘুরপাক খেয়েছে ৫.৫-৬.৫% এর মধ্যে। অর্থাৎ একবারের জন্যেও এমনকি ৭% এর ঘরেও যেতে পারেনি। যা আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ায় মহাজোটের ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তোলে। অন্যদিকে ব্যাংক, শেয়ারবাজার ইত্যাদি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট, জনগনের একটা বিরাট অংশকে গুমখুনের ভয়ে তটস্থ রাখার কারনে পৃথিবীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কোন কোন দেশ প্রবৃদ্ধিকে ৮% এর উপরে নিয়ে গেলেও বাংলাদেশে ৬% গন্ডি পেরোতে পারেনি।
আওয়ামীলীগের মহাজোটের দ্বিতীয় শাসন আমল:
এসময়ে আওয়ামীলীগ সরকারে এসেছে মোটাদাগে বিনা ভোটে জোর করে। অর্থাৎ বাংলাদেশ আবার স্বৈরাতান্ত্রিক শাসনে প্রবেশ করে। দেশের তরুনদের একটি বিরাট অংশ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর না করে ফেসবুক, অনলাইন মার্কেট ইত্যাদির মাধ্যমে গ্লোবালাইজেশনের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো নিতে শুরু করে। এতে দেশের অর্থনীতির গতি অনেকটা বাড়ে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার সীমিত পরিমানে বেড়ে ৭% এর ঘরে পৌছায়। কেবল স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার সুযোগ উম্মোচিত করলে এর পরিমান ৮-৯% এর ঘরে পৌঁছুতো বলে অনেকের ধারনা। সরকারী উদ্যোগতো নয়ই, বরং উবারের মত সার্ভিস ব্যবসাগুলোও সরকারের কর্তাদের বড় অংকের টাকা খাইয়ে দেশের মাটিতে ব্যবসা শুরু করতে হয়েছে। অর্থাৎ সরকার প্রযুক্তি বান্ধব না হয়ে টেবিলের নীচের লেনদেনের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে রোধ করে রেখেছে। অন্যদিকে এসময়েও আওয়ামীলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এবং এটা মেটাতে সরকার লাগামহীনভাবে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে জনগনের ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে জনপ্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকায়। এই ঋণের সুদ বাবদই বাংলাদেশকে প্রতিবছর পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তদুপরি অস্থায়ী ভিত্তিতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মান করে অনেক টাকা খরচের মাধ্যমে বিদ্যুত সমস্যার সাময়িক উন্নয়ন দেখালেও অচিরেই এটা মুখ থুবড়ে পড়বে এটা নিশ্চিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের মত রাইজিং অর্থনীতির একটা দেশে (যেখানে সরকারের গঠনমুলক অবদান খুবই অক্ম, বরং বেসরকারী উদ্দ্যোগই প্রধান) প্রায় একযুগ ক্ষমতায় থেকেও সরকার ১ কিলোমিটারও আন্তর্জাতিক মানের হাইওয়ে তৈরি করেনি এই একবিংশ শতকেও।
সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশে গনতান্ত্রিক যুগে পদার্পনের পরেই ৫% এর ঘরে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছিল প্রায় প্রতিটি সরকারের সময়েই। তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় আওয়ামীলিগের সময়গুলোতেই বাংলাদেশ মুলত প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে কিছুটা পিছিয়ে ছিল। সবচেয়ে বড় কথা যে সময়টাতে মালদ্বীপ, নেপাল, ঘানা, ইথিওপিয়ার মত দেশগুলোও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেদের প্রবৃদ্ধিকে ৮-১০% এর ঘরে নিয়ে যাচ্ছে সে সময়ে দুর্নীতি আর দুঃশাসন দিয়ে একটা তরুণ জনগোষ্ঠী পেয়েও বর্তমান সরকার প্রবৃদ্ধিকে সবে মাত্র ৭% এর ঘরে পৌছিয়েছে। দুর্নীতি আর অপশাসন কখনো ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না, বর্তমান আওয়ামীলীগের মহাজোটের শাসন এর বড় প্রমান। পুর্ববর্তী সরকারগুলোর কার্যক্রম থেকে দেখা যাচ্ছে মহাজোটের এই জোর করে চেপে বসা সরকারের পতন হয়ে জনগনের সরকার আসলে দেশের অর্থনীতি আরো বেগবান হবে এবং প্রবৃদ্ধি ৮% এর ঘরে পৌঁছুবে। সামনের নির্বাচনে জনগনই এর ফায়সালা করতে পারে।
(লেখকঃ অলবোর্গ ইউনিভার্সিটি, ডেনমার্ক)