তামিম হিশামি (স্টাফ রিপোর্টার)
যেকোন দেশের জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানারকম রাজনৈতিক মেরুকরন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনা। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি দল থাকছে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াতের ভূমিকা বিশেষ প্রভাব ফেলছে, থাকছে আলোচনায়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হওয়ায় বামদলসহ বিরোধী শিবির থেকে নানা সমালোচনাও পোহাতে হয় দলটিকে। কিন্তু তারপরও জামায়াত কি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বা আলোচনার অন্তরালে চলে যাচ্ছে? নিবন্ধন বাতিল হওয়া এই রাজনৈতিক দলটিকে নিয়ে কেনই বা সরব থাকছে বিরোধী রাজনীতিকরা? নির্বাচনে প্রভাব ফেলার মত কি এমন শক্তির অধিকারী জামায়াত?
জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে এরকম অনেক প্রশ্ন থাকলেও সমালোচকরা তাদের মোকবেলায় আদর্শিক দিক থেকে বরাবরই থাকছে পশ্চাতে। কিন্তু জামায়াতের জনপ্রিয়তা কতটা হ্রাস করতে পেরেছে সমালোচক ও ক্ষমতাসীনরা তাও হিসাব-নিকাশ করার সময় এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের শাস্তিকার্যকর করার পরও জামায়াত যদি সত্যিই কোন ফ্যাক্ট না হয় নির্বাচনে, তাহলে কেনইবা বারবার আওয়ামীলীগ সহ বাম দল গুলো বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে আলাদা করার নানা কৌশল ও যুক্তি তুলে ধরেছেন? অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনাই জামায়াতকে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে তুলে ধরেছে।
আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নূহ-উ-আলম লেলিন একটি টিভি টকশোতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের একটি মন্তব্যের জবাবে বলেছিলেন, ‘সত্তরের দশক থেকে এখন পর্যন্ত জামায়াত প্রতিটি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে ৪-৬% ভোট পেয়ে আসছে।’ অন্যদিকে সেলিম সাহেবদের মত যারা খ্যাতিমান ব্যাক্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান ও বড় বড় বুলি আওড়ান তাদের অবস্থান জামায়াতের ধারের কাছে নেই। প্রসঙ্গত; বাংলাদেশের সকল জেলা ও উপজেলায় প্রান্তিক পর্যায়ে জামায়াতের কর্মী-সমর্থক ও ভোটার রয়েছে যা জোটের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করবেই তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বিশ^ রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেল গত নির্বাচনে নিজের চ্যান্সেলর পদটিকে ধরে রাখতে অধিকাংশ মন্ত্রীত্ব অন্যদলকে দিতে চান। মূলত; যারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী তারা অবশ্যই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হতে বাধ্য এবং বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যাগে দ্বিধা করেননা। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিভেদ ভুলে জাতির ক্রান্তিকালে বৃহত্তর স্বার্থে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় আসেন।
বর্তমান সরকারের আমলেই চতুর্থ উপজেলা পরিষদের ২০১৪ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াত উপজেলা পর্যায়ে ৩৬ জন চেয়ারম্যান, ১২৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান এমনকি ৩৬জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। যাকিনা জামায়াতের ভোট ব্যাংকেরই ইঙ্গিত বহন করে। এসব স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এককভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছে, যেখানে অন্যরা দলীয়ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে হেরেছেন।
জোটগত নির্বাচনে ২৩ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতের এই ভোট ব্যাংক শতভাগ কাজে লাগাতে পারবে। পাশাপাশি জামায়াতের কর্মী সমর্থক ও ভোটারদের দলীয় আনুগত্যের কারণে জোটের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পিছপা হবে না। আর একারণেই ক্ষমতাসীনরা জামায়াতকে নির্বাচনে ফ্যাক্টর মনে করে নানা রকম নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। গতকাল ২৪ নভেম্বর শনিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিম রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ প্রশাসন, ইসি সচিব হেলাল উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদ হোসাইন, সহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে গোপন মিটিং করে সারাদেশের ইলেকশনকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে আওয়ামীলীগকে জিতিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন, যা গণমাধ্যমে এখন চাউর হয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা তফসিল পরবর্তী দলীয় ভূমিকায় ফুটে উঠেছে। নির্বাচনী তফসীল ঘোষণার পর জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সারাদেশে ৬১ টি সংসদীয় আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এমনকি জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান স্বয়ং রাজধানীর ঢাকা-১৫ সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। যা কিনা এবারের আসন্ন নির্বাচনে বাড়তি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে, কেননা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বা সেক্রেটারী রাজধানীতে নির্বাচন করছেন না। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময় নেতা-কর্মীদের অত্যন্ত প্রফুল্লও দেখা গেছে, যদিও দলটির সাংগঠনিক সকল কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনার সুযোগ দিচ্ছে না সরকার ও প্রশাসন।
২৩ দলীয় জোটের শরীক হিসেবে জামায়াত বিএনপির কাছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য ৫০ টি আসন চেয়ে একটি তালিকা জমা দিয়েছেন। যেসকল আসনে প্রার্থীতার জন্য তালিকা দেয়া হয়েছে, সেসকল সংসদীয় আসনে জামায়াতের বেশ শক্ত অবস্থান আছে বলেও জামায়াত সূত্র নিশ্চিত করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিতে আসবেন বলেও দলটির হাইকমান্ড ইঙ্গিত দিয়েছে।
জামায়াতের তৃনমূল পর্যায় থেকে শুরু করে বেশিরভাগ নেতৃত্বে রয়েছে একঝাক আদর্শবাদী তরুন মেধাবী। যারা তরুন ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছে। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেবার মত যোগ্যতার কারণে তরুনরা তাদের দিকে ঝুঁকছে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে হামলা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি, তনু হত্যাকান্ড, বিশ্বজিৎ হত্যা, শাহজালালে ছাত্রীকে ছাত্রলীগ কর্মী বদরুলের পৈশাচিক চাপাতির কোপ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সেক্রেটারী কর্তৃক শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি পেটা করায় তরুনদের সাধারন সহানুভূতি ও সমর্থন হারিয়েছেন। অন্যদিকে সরকার ও আওয়ামীলীগের এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জামায়াত বরাবরই সোচ্চার প্রতিবাদ করেছে। এতে দলটির জনপ্রিয়তা ও সমর্থন বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বহুদলীয় রাজনীতিতে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। যেকোন অবস্থাতেই এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করা উচিৎ নয়। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জনআকাঙ্ক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন শক্তি এটিকে বাধাগ্রস্থ করবে তা কেউই কামনা করে না। দেশের প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিকদলসমূহ, নির্বাচনকালীন সরকার সকলকেই জাতির কল্যাণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা করবেন বলেই দেশের সকলে প্রত্যাশা করে । একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় রাখার পক্ষে কোন প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ কাজ করবে তা দেশের সাধারন ভোটার মেনে নেয়ার মানসিকতা রাখে না বরং প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসই রাখে। এরুপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে দেশ একটি ক্রান্তিকালে নিপতিত হওয়ার আশংঙ্কা থেকেই যায়।