ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আটঘাট বেঁধে মাঠে নামার প্রস্তুতিতে পাল্টে যেতে পারে সব হিসাব-নিকাশ। ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর বিএনপি নির্বাচনমুখী হওয়ায় হঠাৎ করেই হাওয়া বদলে গেছে। প্রশাসননির্ভর আওয়ামী লীগ নতুন কৌশল খুঁজছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট নেতৃত্বের আসনে বসে বিএনপিও সতর্কভাবে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। তিন দিন ধরে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে নেতাকর্মীদের ভিড় যেমন লক্ষণীয় তেমনি রমরমা অবস্থা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দুই দলের নেতাকর্মীরাই ঢাকা আসছেন। প্রার্থীর সমর্থকদের সরব পদচারণায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অফিস এখন মুখর। হাওয়া বদলের সুর তৃণমূল পর্যায়েও ছড়িয়ে গেছে।
গত দুই দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, দু’দলের কর্মী সমর্থকেরাই উচ্ছ্বসিত। ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই শিবিরই। বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা কিছুটা ভীতির মধ্যে থাকলেও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা নির্ভার। অনেক বিএনপি কর্মী হাইকোর্টের বারান্দায় দিনের একাংশ ঘোরাঘুরি করে বিকেলে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা না থাকলেও তারা একই এলাকার ভিন্ন ভিন্ন নেতার অনুসারী হয়ে ঢাকা আসছেন। আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে ‘আবার ক্ষমতায় আসার’ যে আগাম ঘোষণা প্রচার হচ্ছিল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার খবর তাতে পানি ঢেলে দিয়েছে। দুই পক্ষই এখন নির্বাচনমুখী রাজনীতির নতুন হিসাব কষছে।
নেতাকর্মীরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির যে সরল হিসাব করছেন এবারে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সে হিসাব মিলবে না বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। ওই নির্বাচনে বিএনপি ও তার প্রধান মিত্র জামায়াত অংশ না নিয়ে বয়কট করেছিল। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। যদিও নির্বাচনকালীন প্রশাসন সরকারের নিজস্ব ছকে সাজানো। বিএনপি ও জামায়াতের অধিকাংশ নেতাকর্মী মামলার ভারে কাতর। তৃণমূলপর্যায়েও পুলিশের হানা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। নির্বাচন হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এক ধরনের ভয় ভীতি ও জবরদস্তিমূলক অবস্থা বিরাজ করছে।
বিএনপির প্রধান কাণ্ডারি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে উল্লেখ করার মতো কোনো ছাড়ও দেয়া হয়নি। কোণঠাসা অবস্থায় বিএনপি ড. কামাল হোসেন, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি মোর্চা ভিন্ন এই ফ্রন্টের কোনো রাজনৈতিক কাঠামোও নেই। ফলে সরকার অনেকটা ধরেই নিয়েছিল ছাড় না দিলে তারা নির্বাচনে না-ও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি, যুক্তফ্রন্ট, কিছু ইসলামী দলকে নির্বাচনে শরিক করে বৃহৎ বিরোধী দল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সরকার গঠিত হবে। রাজনীতির মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে আসার ঘোষণায় সব হিসাব পাল্টে গেছে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির অবস্থা অনেকটা আহত বাঘের মতো। ঘুরে দাঁড়ানো ভিন্ন তাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। তাদের প্রতি রয়েছে বিপুল মানুষের সমর্থন। পক্ষান্তরে সরকার যতই উন্নয়নের রাজনীতির ঢাকঢোল পিটাক না কেন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এবং দেশে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা তৈরি করায় তাদের ইমেজ নিদারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। রাজনৈতিক ঐতিহ্যের যে ধারাবাহিকতা আওয়ামী লীগের ধমনিতে রয়েছে তা এখন ঝাপসা এক ইতিহাসের অংশ। বিভক্তির রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরির জন্য তাদেরকেই দোষারোপ করা হয়। আওয়ামী লীগ এ অবস্থায় টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার যে পরিকল্পনা করছে তাতে আকস্মিক ছন্দপতন ঘটেছে। বিএনপি জোটের নির্বাচন প্রস্তুতিতে সব পরিকল্পনা উলট-পালট হয়ে যেতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনকে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নিয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা যদি মাঠে টিকে যেতে পারে তবে সরকারের কোনো কৌশলই কাজে আসবে না।
বর্তমান নির্বাচনমুখী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। কিন্তু তা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে কি না তা দেখার বিষয়। নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ। এ জন্য সহায়ক পরিবেশ প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচন উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশে হবে এটাই প্রত্যাশিত। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সবার জন্যই প্রয়োজন। সেটা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি। ড. মজুমদার বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম সচেতন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত না হলে এই প্রজন্ম বিপথগামিতার ঝুঁকি রয়েছে। নির্বাচনে যাতে সত্যিকারের প্রতিযোগিতা হয়, সবার সমানাধিকার নিশ্চিত হয় সেদিকে সবার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
সূত্র: নয়াদিগন্ত