অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে সব ধরনের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ করবে। কিন্তু সেই কথা তো তারা রাখেইনি বরং এই হত্যাকান্ড তারা আগের চেয়ে দ্বিগুন গতিতে অব্যহত রেখেছে। আর নতুন করে সংগে যোগ করেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম ও অপহরণের মত জঘন্য কৌশল।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পরপর দুই মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগ আইন ও প্রশাসনকে এমনভাবে কুক্ষিগত করেছে যে মানুষের বাক স্বাধীনতা এবং অন্যন্য মৌলিক অধিকারও এখন খর্ব হচ্ছে প্রতিনিয়তই। পাশাপাশি আটক করে গোপন কোন স্থানে নিয়ে বন্দী করে রাখার প্রবনতাও বেড়েছে আশংকাজনক হারে। শুধু তাই নয় গত ১০ মাসে ৪২২ জন মানুষ বিনাবিচারে বা পুলিশের কাস্টডিতে নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। হতাহতের এই সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০১৭ সালে ১৫৫ জন, ২০১৬ সালে ১৭৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৬ জন, ২০১৪ সালে ১৭২ জন, ২০১৩ সালে ৩২৯, ২০১২ সালে ৭০ জন, ২০১১ সালে ৮৪ জন, ২০১০ সালে ১২৮ এবং ২০০৯ সালে ১৫৪ জন মানুষ বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল বলে জানায় সংস্থাটি।
২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করারও কথা বলেছিল। কথা ছিল মানবাধিকার রক্ষায় একজন ন্যায়পাল নিয়োগেরও। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতকির্ত নির্বাচনের আগেও প্রধানমন্ত্রী মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে জেনেভায় ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ সেশনে এবং ২০১০ সালের ১ মার্চ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সভায় যোগ দিয়েও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড এবং কারাগারে নির্যাতন করে মানুষ হত্যা বন্ধের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু ঘরে কিংবা বাইরের মহলে দেয়া প্রতিশ্রুতির এক শতাংশও সরকার পূরণ করেনি। এই মন্তব্য করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান জানান ২০০৯ এর ১ জানুয়ারী থেকে ২০১৮ এর ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে ১৯৮৭ জনকে। আর শুধুমাত্র চলতি বছরের মে থেকে আগষ্ট পর্যন্ত ৩ মাসের কথিত মাদক বিরোধী অভিযানের সময় বিনাবিচারে হত্যা করা হয়েছে আরো ২৫৫ জনকে। আর আটকের পর থানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে ৫৯০ জনকে। যার মধ্যে অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই।
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মী নূর খান জানান, সাধারনভাবে আমরা সবাই ক্রসফায়ার নিয়ে কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে নতুন যে সংকটটা বর্তমানে বেড়েছে তাহলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম ও অপহরণের ঘটনা। অধিকারের হিসেবে গুমের শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার ব্যক্তি। এর মধ্যে ৫৫ জনকে পরে আবার পাওয়া গেছে। ২৫৮ জনকে গোপন জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিল যাদেরকে পরবর্তীতে আইন শৃংখলা বাহিনীর মাধ্যমে কোর্টে চালান করে দেয়া হয়। আর কমপক্ষে ১৪১ জন এখনো নিখোঁজ আছেন যাদের কোন তথ্যই এখন আর পাওয়া যাচ্ছেনা।
সরাসরি অভিযোগ পাওয়া গেছে শুধু সেই গুমের ঘটনাকেও যদি ধরা হয় তাহলে দেখা যায় ২০০৯ সালে গুম হয়েছিল ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জন, ২০১৫ সালে ৬৬ জন, ২০১৭ সালে ৮৭ জন এবং চলতি বছরে আগষ্ট পর্যন্ত ৫৬ জন মানুষ গুম বা অপহরণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ সেশনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচার বহির্ভুত হত্যা ও সব ধরনের গুম ও অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনী কাঠামোতে এনফোরস্ড বা ফোরস্ড ডিসএপিয়ারেন্সের কোন সুযোগ নেই বলেও তারা দাবী করেন।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হক অবশ্য মানবাধিকার লংঘনের এসব ঘটনা স্বীকার করেন তবে এগুলোর জন্য তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেই দায়ী করেন। তিনি জানান, তার অফিস থেকে ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে যেখানে তারা পুলিশের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ১৫৬টি অভিযোগের ব্যপারে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোন সাড়া পাননি। মানবাধিকার কমিশনের হিসেবে এই অভিযোগগুলো অনেক আগের, ২০১২ সালের। কিন্তু তথাপি সরকার এই নিয়ে কোন ধরনের সমাধানযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা এই অভিযোগগুলোর মধ্যে ২৭টি অভিযোগ আছে গুমের, ২৪টি নির্যাতনের, ২০ টি হয়রানির, ১২টি ক্রসফায়ারের, ৪টি তদন্ত কাজে অবহেলা করার, ৪টি ভুমি দখলের আর ৪টি চাঁদাবাজির।
তবে সরকার যত কথাই বলুক, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ যেভাবে একের পর এক উঠছে সেটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। আর সরকার যেভাবে এই অভিযোগগুলো খন্ডন করছে বা পরিস্থিতিকে অস্বীকার করছে তাও তারা মানতে পারছেনা। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৯ তম অধিবেসনে এশিয়ান লিগাল রিসোর্স বাংলাদেশকে নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ভিন্নমতের হলেই তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। গণগ্রেফতার বেড়েছে যার শিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী। কারাগারগুলো ভরে উঠেছে আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের ঘটনা অব্যহত রয়েছে। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের উপর নিপীড়নের মাত্রা আশংকাজনকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।