অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
যে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ আজ পড়ে আছে তা একদিনে তৈরী হয়নি। বিগত কয়েক বছরের ইতিহাস নিয়ে যারা নিয়মিত চর্চা করেন তারা জানেন, বাংলাদেশ আসলে ভু-রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গিয়েছে ২০০১ সালের পর থেকেই। একসাথে ৬৩টি জেলায় বোমা ফাটিয়ে বাংলাদেশকে যেমন জঙ্গী রাষ্ট্রের আখ্যা দেয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি ২১ আগষ্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজন আর বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছিল।
খুব বেশী আগের ঘটনাকে যদি নাও টেনে আনি, তথাপি এই কথা বলাই যায় যে ওয়ান ইলেভেন এবং পরবর্তী জরুরী অবস্থা দেশকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দেশ চালিয়েছে। তখন জামায়াত ছিল রাষ্ট্রীয় এবং সরকারী সব কার্যক্রমের অংশীদার। জামায়াতের লোকেরা তখন বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী অফিসে অবাধে যাতায়াত করেছে, প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছে।
কিন্তু মেয়াদের শেষ দিকে হঠাৎ করেই জামায়াতকে অস্পৃশ্য বানানোর আন্দোলন শুরু হয়। হঠাৎ করে জামায়াতকে সব জায়গা থেকে বাদ দেয়ার কথা শুরু হয়। একই সংগে মিডিয়ার টকশোগুলোতে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে আলোচনা শুরু হয়। দাবী দাওয়াগুলো প্রাথমিকভাবে টিভি টকশো আর পত্রিকার লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপরই হঠাৎ করে এই দাবীটি ভিন্নমাত্রায় পৌছে যায় যখন সেই মহলটা দাবী করে বসে যে বঙ্গভবনে বা রাষ্ট্রীয় কোন আয়োজনে জামায়াতকে যেন নিমন্ত্রণ না জানানো হয়। প্রথম বছর সেই দাবীতে সাড়া দেয়নি বঙ্গভবন। তাই রাষ্ট্রের প্রোগ্রামও বয়কট করতে শুরু করে সেই গোষ্ঠী। এরপরের বছর থেকে বঙ্গভবন ও গণভবনসহ রাষ্ট্রীয় সকল আয়োজন থেকে জামায়াতকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়।
কেউ প্রশ্ন করলো না, এই পক্ষটি কারা যারা হঠাৎ করে এই ইস্যুটি সামনে নিয়ে এলো? কিংবা যেই জামায়াত এতদিন বঙ্গভবন বা গণভবনে নিয়মিত যেতে পারলো, ২০০৬ সালের পর এমন কি হলো যে সেই দলটিকে আর কোথাও যেতে দেয়া হবে না? আজ ১২ বছর পরে এসে যখন জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন নির্বাচন কমিশন বাতিল করে কিংবা উচ্চ আদালতে যখন জামায়াতের বিরুদ্ধে রায় দেয়, তখন সেই পুরনো ঘটনাগুলোর সাথে আজকের ঘটনাবলীর যোগসূত্র বের করাটা সহজ হয়ে যায়।
জামায়াত নিয়ে এত কথা বললাম কারন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সংলাপের সাথেও জামায়াতের নাম জড়িয়ে আছে। যদিও শেষ অবধি জামায়াত সেই সংলাপে যেতে পারেনি, তথাপি সেই সংলাপটিও অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছু দিতেও পারেনি। আমার মনে আছে যখন বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপের কথা বলা হয়, তখন প্রাথমিকভাবে জোট ভিত্তিক আলোচনাই হওয়ার কথা ছিল। সেটা হলে হয়তো বাংলাদেশ রাজনৈতিক সংকট থেকে বেঁচেও যেত।
কিন্তু বিধি বাম। আবারও সেই শোরগোল। দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা বললো, সংলাপে জামায়াতের কেউ থাকতে পারবেনা। বাধ্য হয়ে শরীক দলগুলোকে বাদ দিতে হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-উভয় দলের। একটি জাতীয় সংলাপের পরিবর্তে সংলাপটি হয়ে গেলো দুই মোড়লের সংলাপ। সংসদ ভবনের ভেতরে হয়েছিল সংলাপটি। বাইরে উৎসুক মিডিয়ার সে কি ভীড়। অনেকটা বর্তমান সময়ের বাস্তবতার মতই। দুই মহাসচিব জনাব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া ও আব্দুল জলিল ফটোসেশন করলেন। কি সব কথা বললেন, দুদিন পর দেখা গেলো সংলাপটি ব্যর্থই হয়ে হলো।
রাজনৈতিক কোন সংকটের সমাধান এরকম একপেশে সংলাপ দিয়ে করা যায়না। বর্তমানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ড. কামাল হোসেনের সংলাপ দিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, আমি মনে করিনা এটা দিয়েও কোন সমাধান হবে। মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপার্সনের কারাদণ্ডকে ৫ বছরের জায়গায় ১০ বছর করা হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে তখনই আসলে সংকট সমাধানের কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে।
ড. কামাল বা মাহমুদুর রহমান মান্নারা এখন পরিস্থিতির কারনে আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা উভয়েই আওয়ামী বটবৃক্ষের উৎপাদন। তাই তারা দিন শেষে আওয়ামী আদর্শের প্রতিই দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের প্রচলিত আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিকে তারা ধারণও করেন না, ভারত বিরোধী দর্শনকেও না। আ.স.ম আব্দুর রব তো আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের। আর ডা. জাফরুল্লাহ হলেন বিএনপির লোক কিন্তু তিনিও বিভাজনের চর্চা করেন। জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়ার অযুহাতে ২০ দলীয় জোটে বিভাজন সৃষ্টির এজেন্ডা নিয়ে তিনি কাজ করছেন অনেকদিন থেকেই।
এই জাতীয় মানুষগুলোকে দিয়ে জনগনের মুক্তি হবেনা কোনভাবেই। তারা হয়তো খুব আয়েশ করে কথা বলবেন, ডিনার করবেন। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন ইস্যু নিয়ে কথা বললেই ১০ বছরের স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর নেমে যাবেনা। বিগত ১০ বছরে এই জনপদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে অগনিত মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জীবন দিয়েছে, হাত পা হারিয়েছে, কারাগারে জীবনের সোনালী সময়টা বিসর্জন দিয়েছে তাদের কারও সাথেই এই নেতাদের কোন আত্মিক সম্পর্ক নেই। তাই হালুয়া রুটির সমাধানে তাদের মন ভরলেও শোষিত জনগন স্বস্তি পাবেনা, আর জনগনের কাঙ্খিত মুক্তিও আসবেনা।
আর বিএনপি নেতাদের নিয়ে বেশী আশাবাদ না করি। ৭৪ বছরের নেত্রী যখন হাসপাতালের করিডোরে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, ওনারা তখন পাঁচ তারকা হোটেলের করিডোরে। বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহাসিক সার্কাস এখন হচ্ছে যখন একটি দলের চেয়ারপার্সন ১০ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে হাসপাতালে ধুকে ধুকে মরছেন আর তারই দলের মহাসচিব দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সরকারী বাসভবনে মজার সব খাবার খেতে যাচ্ছেন। এই সংলাপকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে বিএনপির সাথে জাতীয় ঐক্যের সম্পর্কে ফাটলও ধরতে পারে।
আমার কথাগুলোকে হয়তো অনেকের কাছে নেগেটিভ মনে হতে পারে। তবে আমাদের পিছনের বাজে অভিজ্ঞতাই আমাকে এমন বলতে বাধ্য করেছে। আমি মনে করি, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের গভীরতা আর জনগনের হাহাকারগুলো আমাদের নেতারা এখনো বুঝতে পারেননি। এই পরিস্থিতির সমাধান জালিমের সাথে সংলাপ করে আদৌ হওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। তবে আপাতত বড় কথা হলো, এত বড় সমস্যার সমাধান জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের দিয়ে করা সম্ভব নয়। যদি আসলেই কোন অর্থবহ ও কার্যকরী রাজনৈতিক সংলাপ করতে হয়, তাহলে সংকীর্ণ মানসিকতা আর বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে বাংলাদেশের সকল দলের অংশগ্রহনে সংলাপ করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।