অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কেবল বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নয় খোদ নিজ দলের নেতাকর্মীদের রগ কাটা, হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বরাবরই। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এ ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিপক্ষের উপর হামলা, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ছিনতাই, ধর্ষণ কিংবা নিজ দলের কর্মী খুনসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে, যা চলছে এখনো এবং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
অ্যানালাইসিস বিডির গবেষণায় দেখা যায়, শুধুমাত্র চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংগঠনটির হাতে খুন হয় ২৭ জন। তার অধিকাংশই ছাত্রলীগের নিজ দলের নেতাকর্মী।
২০১৮ সালের এই পর্যন্ত পুরো সময়টা জুড়েই খবরের শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। প্রতিবারই কোনো না কোন খুন কিংবা জখমের মাধ্যমে। গবেষণায় দেখা যায় বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের হাতে খুন হয় ৬ জন।
৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে এই বছরের প্রথম শিকার হয় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির দেউটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাকিল (২২)। আভ্যন্তরীন কোন্দলের জের ধরে একই এলাকার ছাত্রলীগের অন্য গ্রুপের নেতা লিটন তাকে গুলি করে হত্যা করে।
১৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে এই বছরের দ্বিতীয় খুনটি হয়। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির বলি হয় কলেজিয়েট স্কুলের ১০ শ্রেণীর ছাত্র আদনান ইসফার। স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করে চন্দনপুরা এলাকার ছাত্রলীগ নেতা সাব্বিরের অনুসারী মাঈন।
২০ জানুয়ারি ফেনী পৌর শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের অপর গ্রুপের ছুরিকাঘাতে ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা আহম্মদ শাকিল নিহত হয়। নিহত শাকিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার গুণবতি গ্রামের হুমায়ুন কবিরের ছেলে।
২৫ জানুয়ারি একই কারণে নোয়াখালীর ছাত্রলীগ কর্মী মো. মুরাদ উদ্দিন এবং ২৬ জানুয়ারি সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর শিকদার (২৫) কে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী গ্রুপ।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এবার পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে ফেনীর দাগনভূঞায় যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম ইদন মিয়াকে (২৮)।
অ্যানালাইসিস বিডির গবেষণায় দেখা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু গৌরবান্বিত মার্চ মাসে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে ছাত্রলীগ। ০৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আশফাক আল রাফী শাওন কে পেটে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধ শুরু মাসের কার্যক্রম শুর করে।
মার্চ মাসের পরের শিকারটি হয় বরগুনার পাথরঘাটা পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুল্লাহ (২৩)। প্রতিপক্ষের রক্তের নেশায় বুদ হওয়া একই এলাকার পৌর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ছাত্রলীগ নেতা আতুর সোহাগ ও সহযোগীদের হামলায় ০৮ মার্চ ২০১৮ প্রাণ হারান তিনি।
২৫ মার্চে তৃতীয় খুনটি হয় খাগড়াছড়িতে। আবারও আভ্যন্তরিন কোন্দল, আর তাতে এই মাসে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিজ দলের খাগড়াছড়ি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কর্মী মো. রাসেল (১৭) খুন হয়।
প্রতিমাসে রুটিন করে খুন করা যেন ছাত্রলীগের নেশায় পরিণত হয়েছে, আর তাই এপ্রিল মাসেও ছাত্রলীগের হাত তিন খুনের খবর গবেষণায় উঠে আসে। বছরের ১১তম খুনটি হয় পাবনার ঈশ্বরদীতে।
১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে নিজেদের আভ্যন্তরীন কোন্দলের শিকার পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সদরুল আলম পিন্টু (৩২)। পুলিশ অবশ্য সাথে সাথেই এই ঘটনায় ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের দিয়ার সাহাপুর গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে সাহাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ১নং ওয়ার্ড শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ইমন ইসলাম (২২) ও ছলিমপুর ইউনিয়নের মানিকনগর গ্রামের ডা. কাজী সাইফুল ইসলামের ছেলে ছাত্রলীগকর্মী তৌফিক হাসান বৃত্ত (২০)কে হত্যার দায়ে গ্রেফতার করে।
১৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ফরিদপুরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা হত্যা করে মান্নান সিকদার (৫৫) নামে এক আওয়ামীলীগ সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করে।
২৭ এপ্রিল ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামে বুকে গুলি করে হত্যা করে যুবলীগ কর্মী ফরিদুল ইসলাম ফরিদ (৪০) কে।
৩০ মে ২০১৮ তারিখে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে গিয়ে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ছাত্রলীগের এক সন্ত্রাসী গ্রুপ জেলা ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল ইসলামকে (২৭) গুলি করে হত্যা করে।
খুনের জগতে প্রতিমাসে ধারাবাহিকতা রাখা যেন ছাত্রলীগের ধর্ম। সেটা লক্ষ্য করা যায় প্রতিমাসের খুনের সংখ্যার দিকে খেয়াল করলে। প্রতিমাসেই যেন হ্যাট্রিক খুন করা চাই তাদের। আর তাই জুন মাসেও হ্যাট্রিক খুন হয়।
০১ জুন ২০১৮ তারিখের এ মাসের প্রথম খুন করা হয় মৌলভীবাজারের বড়লেখায় উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়ন সামছুল ইসলাম নামে এক যুবলীগ নেতা। বাজারের টেন্ডারবাজী নিয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা হত্যা করে তাকে।
১৮ জুন ২০১৮, এই মাসের দ্বিতীয় বর্বর ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার চট্টেশ্বরী মোড়ে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাবার সামনে ছেলে মো. অনিককে (২৬) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দামপাড়া ২ নম্বর পল্টন এলাকার ছাত্রলীগের কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী।
২৩ জুন পূর্ব শত্রুতার জেরে বোমা হামলা ও ছুরিকাঘাতে যুবলীগ নেতা আরাফাত রহমান লিটন (৩২) কে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।
গবেষণায় দেখা যায়, ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হাতে পর্যন্ত অস্ত্র পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আর তার সুবাধে ছোট-খাটো বিবাদেও হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটাচ্ছে ছাত্রলীগ।
০৫ জুলাই ২০১৮ তারিখে সিরাজগঞ্জে বাড়ি থেকে মোবাইলে ডেকে নিয়ে বাগবাটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সংগ্রাম শেখকে (২৮) কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে একই ইউনিয়নের বর্তমান ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা।
একই মাসের ৩০ তারিখে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া এলাকায় মহানগর যুবলীগের সদস্য সাজ্জাদ আলম শেখ আজাদ ওরফে আজাদ শেখকে (৪০) গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।
অ্যানালাইসিস বিডির গবেষণায় দেখা যায়, ছাত্রলীগের হাতে এই বছরের (২০১৮) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খুন হয় আগস্ট মাসে। আগস্ট মাসে পাঁচটি খুন করে ছাত্রলীগের মূল কাজ হত্যার রাজনীতি তার জানান দেয়।
০১ আগস্ট ২০১৮ তারিখে ফেনীতে তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে ইফতি নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে তারই দলের কর্মীরা।
১৭ আগস্ট এই মাসের দ্বিতীয়খুনটি হয়। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার লাতুরগাঁও গ্রামে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের অস্ত্রের আঘাতে মহিবুল হোসেন (৩৫) নামে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়।
২৭ আগস্ট ২০১৮ তারিখে জেলার সীতাকুণ্ডে জাতীয় শোক দিবসের সভা শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় রমজান আলী (৩৫) ও তার ভাই মোহাম্মদ সুজন নামে দুই যুবলীগ কর্মী নিহত হয়।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও ছাত্রলীগের হত্যাযজ্ঞ থেমে নাই। এ মাসে দুইটি খুন করে হত্যার জগতে নিজেরদের জায়গা পোক্ত করে তারা।
গত ২৬শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মামুনুর রশীদ (২৬) নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। অপর খুনটি হয় ০১ সেপ্টেম্বর তারিখে, কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা ভানী ইউনিয়নের খাদঘর গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মো. রাব্বি। আভ্যন্তরীন কোন্দলের শিকার সে।
এ গবেষণা প্রসঙ্গে অ্যানালাইসিস বিডির রিচার্স সেলের প্রধান মিরাজ খন্দকার জানান, বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটার পর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
এই তালিকা নিয়ে ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে অ্যানালাইসিস বিডির পক্ষ হতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ছাত্রলীগের হত্যার রাজনীতি সম্পর্কে সাংবাদিক ও ছাত্ররাজনীতি বিশ্লেষক গালিব আহসান বলেন, রাজনীতি হওয়া উচিত ছাত্রবান্ধব ও ছাত্রকল্যাণমুখী। আজকের ছাত্রনেতারাই আগামীদিনের জাতীয় নেতা। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি যদি হয় সন্ত্রাস নির্ভর তাহলে আগামী দিনে জাতীয় নেতৃত্ব কি পাবে? প্রশাসনের উচিত নিরপেক্ষ ভাবে সন্ত্রাসীদের বিরোদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
এই তালিকা নিয়ে অ্যানালাইসিস বিডির পক্ষ হতে ছাত্রদলের এক নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছা পোষণ করে বলেন, রাষ্ট্রের সব জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মূলে ছাত্রলীগ । দেখা যায়, তারা সব সময় হত্যা ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত থাকে। তারা সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ নষ্ট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে জিম্মি করে রেখেছে। এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। ছাত্রলীগকে বর্জন করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
ছাত্রলীগের খুনের রাজনীতি প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।