অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ফেসবুকের কল্যানে মাহী বি চৌধুরীর একটি আকর্ষনীয় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুদিন ধরে তথাকথিত প্ল্যান বি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং তরুন সমাজ বেশ সরগরম হয়ে আছে। নানাজনে নানাভাবে প্ল্যান বি নিয়ে তাদের মতামত দিচ্ছেন, সমালোচনা করছেন ইত্যাদি। প্ল্যান বি’র ফেসবুক পেইজে গিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে যেটা দেখলাম তা হলো, তারা সরাসরি কোন রাজনৈতিক ফোরাম হিসেবে নিজেদের দাবী করেনি। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আছে। বোঝা যায়, বড় দুই দলের সাথে তাদের অবস্থানগত ভিন্নতা আছে। আবার এটাও লেখা আছে, তারা স্বাধীনতা বিরোধী অর্থাৎ জামায়াত শিবিরের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেনা। জামায়াত শিবিরকে কারা স্বাধীনতা বিরোধী বলে এতদিনে জনগনের কাছে তা অনেকটাই পরিস্কার হয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে প্ল্যান বিও সেই পথেই হাটছে। অর্থাৎ বাহ্যত নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যতই ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রাখুক না কেন, আসলে রাজনৈতিক কারনেই যে প্ল্যান বি’র আবির্ভাব তা নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। মাহী বি চৌধুরী এই ইস্যুতে কথা বলে আরো প্রমান করে দিয়েছেন যে, সময়ের আলোচিত পরগাছা ফোরাম, যুক্তফ্রন্টের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাবও প্ল্যান বি’র উপরে পড়েছে।
এবার আসুন, প্ল্যান বি’র সাথে যুক্ত মাস্টারমাইন্ডদের খুব নিকট রাজনৈতিক ইতিহাসটা একটু দেখে নেই। প্ল্যান বি অর্থাৎ ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’ নামের এই সংগঠনটি নিয়ে মাঠে নেমেছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী ও তার পরিবার। চলতি মাসের শুরু থেকেই অনলাইনে তাদের কার্যক্রম প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। আর এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন মাহী বি চৌধুরী, তার স্ত্রী ও মেয়ে। তার মেয়ে আমেরিকাতে থাকলেও এই আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য সে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে বলেও জানা যায়। অর্থাৎ গোড়াতেই গলদ। পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে আবার সেই পরিবারতন্ত্রকে পুঁজি করেই নামলেন মিস্টার মাহী।
মাহী বি চৌধুরীর ভাষ্যমতে তারা প্ল্যান বি নিয়ে সারা দেশ ঘুরবেন। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজেও যাবেন। যারা দেশের বর্তমান এই অবস্থার পরিবর্তন চায় তাদের জন্য তরুণ প্রজন্মের দুয়ার খোলা। তবে দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’-এর প্লাটফর্মে আসতে পারবে না মন্তব্য করে বিকল্পধারার এই নেতা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হলে প্রজন্ম বাংলাদেশও তাদের সঙ্গে থাকবে।’
উল্লেখ্য, জামায়াতকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর একটি জোট গঠনের জন্য বিগত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তফ্রন্ট আহ্বায়ক অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা বৈঠক করেছেন। তার মানে বি চৌধুরী ও তার ছেলে মাহী বি চৌধুরী একই কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তবে দুজন ভিন্ন দুই স্টাইলে।
ড. কামাল হোসেনের সাথে বি চৌধুরী সাহেব গাটছড়া বাঁধতে চাইছেন অনেকদিন থেকেই কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। জোট সরকারের আমলের একটি ঘটনা। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন শুরু সকাল থেকে। বিকেলে তা ভাঙানোর কথা ড. কামাল হোসেনের। ভোরের এক ফ্লাইটে ড. কামাল বিদেশে চলে যান। খবরটা ডা. বদরুদ্দোজা জানতে পারেন দুপুরের পর।
‘ক্ষুধার্ত’ ডা. বদরুদ্দোজা পড়েন বেকায়দায়। সাবেক রাষ্ট্রপতির অনশন কর্মসূচি যেন-তেন নেতাকে দিয়ে ভাঙালে দলের মর্যাদা থাকবে না। অনশনস্থলে টুপি পরে কোরান পাঠ শুরু করেন তিনি। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হতেই মাদুর, টুপি, তসবিসহ অন্য জিনিস গুটিয়ে অনশনস্থল থেকে এক প্রকার পালিয়ে যান ডা. চৌধুরী, তাঁর অনশনের নেতাকর্মীরা। সে সময়ে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের প্রেস নোটস কলামে ঘটনাটির রসাত্মক বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছিলো।
যে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়, পাশের আরেকটি রুমেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন বি চৌধুরী। অথচ তিনি ছিলেন অক্ষত। কিছু নাকি টেরও পাননি। এরপর বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের সুযোগ নিয়ে আবার সেই শহীদ জিয়াকে বিক্রি করেই তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, বিরোধী দলীয় উপনেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতিও হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। একসময় আবার সেই বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হয়ে নতুন দল গড়েছেন। আর এখন তিনি আবার এসে বিএনপির সাথে জোট গড়ার জন্য আকাশ ছোঁয়া শর্ত আরোপ করছেন।
মাহী বি চৌধুরীও বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক সুবিধাভোগী ব্যক্তিত্বের নাম। পিতা বি চৌধুরী যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য আবদার করেছিলেন, বাচ্চাদের মত জিদ করে বায়না ধরেছিলেন ঠিক তেমনি বি চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হয়ে মুন্সীগঞ্জের আসনটি ছেড়ে দেয়ার পর উপ নির্বাচনে দাঁড়ানোর বায়না করেন মাহী বি চৌধুরী। বি চৌধুরী তখন প্রেসিডেন্ট। তাই খুব সহজেই পার্লামেন্টে চলে আসেন মাহী। শুধু তাই নয়, বিয়ে করেছিলেন এক সময়ের মডেল আশফাহ হক লোপাকে। পিতা বি চৌধুরী একসময় টেলিভিশনে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করতেন। আর স্ত্রীও মডেল হওয়ায় মাহীর মিডিয়ার প্রতি ঝোঁকও ছিল মারাত্মক। প্রেসিডেন্টের ছেলে হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভির এক ঘন্টার চাংক কিনে নিয়ে সেখানে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শুরু করেন মাহী দম্পতি। অবশ্য বি চৌধুরীর রাষ্ট্রপতির চাকুরী চলে যাওয়ার পর মাহীর সেই অন্যায় সুবিধাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মাহী আর তার স্ত্রীকে খুব একটা মিডিয়ায় দেখা যায়নি। তবে পাঠকদের মধ্যে যারা একটু ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে, কয়েক বছর আগে থার্টিফাস্টে গুলশান বনানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও বারে পুলিশ রেইড দেয়ার সময় সেখান থেকে মাহী বি চৌধুরী ও তার স্ত্রী আশফাহ হক লোপাকেও দেখা গিয়েছিল। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের কল্যানে সেই ছবি এখনও হয়তো অনেকের সংগ্রহে থাকতে পারে।
এবার আসা যাক, প্ল্যান বি’র আলোচিত সেই ভাষনে। আমি অবাক হয়ে যাই, জনগনের চাহিদা, তারুন্যের চাহিদা নিয়ে কথা বলছে এমন একজন ব্যক্তি, এমন একটি দলের যুগ্ন মহাসচিব যার ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ারও সামর্থ্য নেই। তার ভাষনে জনগনের মুক্তির কোন কথা নেই। অসুস্থ ৭৩ বছরের বিধবা নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়েও কোন কথা নেই। আছে টোল, ঘাটের ইজারা, রাস্তাঘাট, ব্রীজের ইজারার হিসেব নিকেষ। যারা শোষনের হাত থেকে জনগনের উদ্ধারের কোন কর্মনীতি না বলে, নিছক চটকদার কথা বলে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়, তারা ফেসবুকে লাইক পেতে পারে, কিন্তু জনগনের ভোট ও আকুন্ঠ সমর্থন কখনোই পাবেনা। যেই তরুনদের জন্য এই প্ল্যান বি, সেই তারুন্য এখন অনেকটাই সচেতন। তারা জানে হালুয়া রুটি আর ইজারার ভাগ পাওয়ার জন্যই রাজনীতির সুবিধাবাদী কিছু উচ্ছিষ্ট এখন প্ল্যান বি নিয়ে নেমেছেন। এসব উচ্ছিষ্ট ব্যক্তিদের ইতোপূর্বে জাতি পরিত্যাগ করেছে, আর সময় আসলে এ জাতি প্ল্যান বিকেও ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট হিসেবেই ছুঁড়ে ফেলে দিবে।