অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আকৃতি, কাঠামো বা জনসমর্থনের দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুলধারার বড় দল হলেও সর্ববৃহৎ দল নয়। কিন্তু এরপরও সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিগত ১০ বছর সরকারের চাপে এক রকমের কোনঠাসায় পড়ে থাকা জামায়াত যেন আবার আলোচনায় ফিরে আসছে। ইতোমধ্যেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সূচী ঘোষনা করেছে নির্বাচন কমিশন। সঙ্গে সঙ্গেই রাজনীতির ময়দানে শুরু হয়ে গেছে নানা হিসেব-নিকেশ। জোট গড়া আর ভাঙ্গার নতুন সমীকরণ।
২০০০ সালে যে চারদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল জামায়াত ছিল তার অন্যতম নিয়ামক। সেই জোটের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা পরবর্তীতে উপলব্ধি করা যায় যখন ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই সরকারে বা জোটে জামায়াত কখনোই সমানুপাতিক হারে মুল্যায়ন পায়নি। জামায়াতকে দেয়া হয়েছিল মাত্র দুইটা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের অন্যন্য প্রতিষ্ঠানেও জামায়াতের কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তারপরও জামায়াত জোটে ছিল। জোটের সব অর্জন ও ব্যর্থতার দায় নিয়েই তাকে থাকতে হয়েছে।
আজ সেই চারদলীয় জোট ২০ দলীয় জোটে পরিনত হয়েছে। যদিও বাকি দলগুলোর বেশীরভাগই নাম সর্বস্ব। এখন আবার জোটকে নানা ফরম্যাটে বড় করার প্রক্রিয়া চলছে। এক সময় যেই বি চৌধুরী বিএনপির দয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আসনেও বসেছিলেন, সেই বি চৌধুরীর বিকল্পধারাও এখন জোটে যাওয়ার জন্য বিএনপিকে শর্ত দিচ্ছেন। সমানুপাতিক হারে আসন চাইছেন। আমি অবাক হয়ে ভাবি, বিকল্পধারার মত গুটিকয়েক ব্যক্তি যদি জোটে যাওয়ার জন্য এই শর্ত দেয়, তাহলে জামায়াত কি শর্ত দিতে পারে? কয়টা আসন চাইতে পারে? কয়টা মন্ত্রীত্ব? এভাবে কি কোন জোট আদৌ গঠন হতে পারে?
বিকল্পধারা আবার এক ডিগ্রী আগ বাড়িয়ে বলছে জামায়াতকে যদি বিএনপি যে কোন ফরম্যাটেই বন্ধু হিসেবে রাখে তাহলে তারা বিএনপির সাথে জোট করবে না। ড. কামালের গনফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বা নাগরিক ঐক্যও একই সুরে কথা বলছে। আসলে বিএনপি বড় দল হওয়ায় তার সাথে দর কষাকষিতে পারবেনা- এটা বুঝেই জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতের পিছনে তারা লেগেছে। কেননা তারা জানে, জোটে জামায়াত যত শক্তিশালী থাকবে, তাদের অবস্থা তত খারাপ হবে।
এসব দলের আকাশ কুসুম গল্পের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি কি বলেছে জানিনা, কিন্তু মনে হচ্ছে বিএনপির কাছ থেকে কাঙ্খিত সাড়া না পেয়েই বিকল্পধারা ড. কামালের গনফোরামের সাথে জোট করেছে। আগামী মাসে ঢাকায় সমাবেশ করারও ঘোষনা দিয়েছে।
এই দলগুলোর বাইরে আরো বেশ কিছু এক ব্যক্তি নির্ভর দলের সাথেও বিএনপি জোট করতে চেয়েছে। বলাই বাহুল্য, তারাও ক্ষমতার অংশীদারিত্বে বড় শেয়ার চেয়েছে। আর সঙ্গে আছে জামায়াতকে ছাড়ার শর্ত। এভাবে বিগত মাস খানেক ধরে জামায়াতকে রাখা না রাখা নিয়ে বিএনপিকে বেশ চাপে রেখেছে চুনোপুটি সাইজের এই দলগুলো। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকায় লাথি মারে। এখন বিএনপির হয়েছে সেই দশা। নেত্রী জেলে। দলের নেতৃত্ব নিয়ে রয়েছে চরম আস্থার সংকট। সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ছোট ছোট দলগুলো এখন বিএনপিকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
জামায়াত এখনো পর্যন্ত এই টানাপোড়েনের ইস্যুতে চুপচাপ। তবে দলটি আবার রাজনীতির বাজারে ফের আলোচনায় এসেছে- এটা বলাই বাহুল্য। জামায়াত কিছু না করলেও তাকে নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে, এটা জামায়াতের একটা বড় অর্জন। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত কতটা সফল, তারা কত ভোট পাবে, কয়টা আসন জিতবে- সেই অংক নিয়ে বির্তক আছে। তবে রাজনীতির আলোচনায় জামায়াত যে বরাবরই এগিয়ে সেটাও নিশ্চিত করেই বলা যায়। এমনকি সরকারও জামায়াতের ব্যপারে বরাবরই সরব। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এমনকি পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন মহলের কর্তাব্যক্তিরাও দেশের সকল ঘটনা ও দুর্ঘটনার জন্য যেভাবে জামায়াতকে দায়ী করে বক্তব্য দেন, তাতে জামায়াত আলোচনায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে বরাবরই। রাজনীতি থেকে জামায়াতকে নির্মুল করার জন্য জামায়াতের প্রতিপক্ষরা এতসব কান্ড ঘটালেও কার্যত তাদের কারনে জামায়াত আরও বেশী করে রাজনীতির ডি-ফ্যাক্টো হয়ে উঠছে কিনা, সেটাও এখন ভেবে দেখার বিষয়।
জামায়াত জোটে থাকবে নাকি থাকবেনা- এটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। কারন জামায়াত ইস্যুর চেয়ে এখন অনেক বড় ইস্যু হলো জনগনের মুক্তি। যেই ছোট দলগুলো জনগনকে মুক্তি দেয়ার ভাবনাকে বাদ দিয়ে, জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারা ও কর্মসূচীর দিকে না এগিয়ে বরং নিজেদের স্বার্থে আসন ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; কিংবা জনগনের মৌলিক সংকটকে দূর করার পরিবর্তে একটি দলকে জোট থেকে বের করে দেয়াকে বেশী গুরুত্ব দেয়, সেই সব দলগুলো দিয়ে জনগনের কোন কল্যাণ কখনোই হতে পারেনা। তাই জনগণ ও দেশের স্বার্থে আমাদের দায়িত্ব হলো, এই ছোট দলগুলোকে ঘৃনাভরে প্রত্যাখান করা, যারা বড় দলগুলোর ঘাড়ে চড়ে মাখন খাওয়ার মানসিকতা নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করছে। আমরা চাই গণমুখী রাজনীতি, গণমুখী নেতৃত্ব।