আফ্রাসিয়াব খটক
পাকিস্তানে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। অতীতের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে কম। দিনের শুরুতে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াবি জেলায় আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির একটি ঘটনায় একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। দেশের বিভিন্ন অংশে অনেক ভোটকেন্দ্রে ছোটখাটো সংঘর্ষের খবরও জানা গেছে। তবে বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার একটি ভোটকেন্দ্রে এক আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত এবং আহত হয়েছে শতাধিক।
আগে থেকেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের কেন্দ্রে থাকা পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী হামলায় রক্তপাত ঘটেছে নির্বাচনী প্রচারণাকালেই। প্রচারণার সময় পাখতুনখাওয়ার পেশোয়ার, বান্নু ও ডেরা ইসমাইল খানে সহিংসতায় নিহত হয়েছে বেশ কিছু লোক। ১৩ জুলাই বেলুচিস্তানের মাস্তুংয়ে একটি নির্বাচনী সমাবেশে আত্মঘাতী এক বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছে দেড় শতাধিক মানুষ। এই নির্বাচনে বেলুচিস্তান যেন আরও অবহেলিত হয়ে পড়েছে; কেননা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো শীর্ষ নেতা ভোট চাইতে সেখানে যাননি। এর কারণ দুটি। প্রথম কারণ, দেশের বৃহত্তম প্রদেশ হওয়ার পরও এর জনসংখ্যা কম। জাতীয় পরিষদের মাত্র ২৩টি আসন রয়েছে এখানে (সরাসরি ভোট হচ্ছে ২৭২ আসনে)। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই প্রদেশের রাজনীতি প্রবলভাবে প্রভাবিত হয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোয়েটাভিত্তিক দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রভাবে। গত বছরের নভেম্বরে সিনেট নির্বাচনের আগে ‘পার্লামেন্টারি অভ্যুত্থানে’ এই প্রদেশে ক্ষমতা হারায় পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) নেতৃত্বাধীন জোট। তখনকার ক্ষমতাসীন দলগুলোর অভিযোগ, প্রাদেশিক সরকারকে উৎখাত ও বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) গঠনে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততা ছিল। আজকের নির্বাচনে দৃশ্যত এ দলই এখানকার অনেক আসন জিততে চলেছে।
দুপুরের পর পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট গ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর অনুরোধ জানায়। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এত ক্লান্তিকর ও ঝামেলাপূর্ণ ছিল যে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) সব ভোটার তাঁদের ভোট দিতে পারবেন না। প্রচণ্ড গরমে অনেক ভোটারই দেরিতে ভোট দিতে যান। গণমাধ্যম ও অনেক পর্যবেক্ষক এ দাবিকে সমর্থন করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই অনুরোধ নাকচ করে দেয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভোট বেশি পড়লে তা ইমরান খানের পিটিআইয়ের জন্য সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক নীলনকশার বিপরীতে পিএমএলেরই (এন) পক্ষে যেতে পারে।
পিএমএল (এন) অভিযোগ করেছে, জেনারেলরা ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন ‘কিংস পার্টি’ পিটিআইয়ের পক্ষে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সম্প্রতি লন্ডনে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) একজন বর্তমান জেনারেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনি তাঁর (নওয়াজ) দলের প্রার্থীদের দল ছাড়তে চাপ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। নওয়াজ শরিফ এমন কথা বলেছেন বলে জানা গেছে যে অতীতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মনে করা হতো ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এটা ‘রাষ্ট্রের ওপরে রাষ্ট্র’।
নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নাক গলানোর এই অভিযোগের আঙুল শুধু নওয়াজ শরিফ বা তাঁর দলেরই নয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতারাও সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির অন্তত তিনজন বর্তমান কর্মকর্তার নাম বলেছেন, যাঁরা বিভিন্ন জেলায় পিপিপির বিরুদ্ধে কাজ করছেন। এর আগে মাহমুদ খান আচকজাইও বেলুচিস্তানে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নওয়াজ শরিফ-বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সংগঠিত করার অভিযোগ করেন। পশতুন ও বেলুচ জাতীয়তাবাদীরাও সন্ত্রাসী হামলার কবল থেকে তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগ করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু উল্লিখিত কোনো অভিযোগেরই তদন্ত হয়নি।
নির্বাচন-পূর্ব ব্যাপক জালিয়াতির কারণে বর্তমান নির্বাচনকে সবচেয়ে ‘জঘন্য’ ও সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পিএমএলের (এন) অনেক প্রার্থীকে দলীয় টিকিট ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একটি বড় অংশ তাঁদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘জিপ’। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাঁরা ‘প্রভাবিত’ হয়ে এমনটি করেছেন, যাতে নির্বাচনের পর সেনা-সমর্থক কোয়ালিশন সরকার তৈরিতে তাঁদের ব্যবহার করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বড় কিছু কাজ সেনাবাহিনীকে দিয়ে করাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। উদাহরণ হিসেবে ছাপাখানা থেকে ব্যালট পেপার নির্বাচন কমিশনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ দেওয়া হয়েছে সেনাসদস্যদের। একইভাবে তাঁরা ভোট গ্রহণের আগে ব্যালট পেপারগুলো ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন। ভোট গ্রহণ শেষেও ব্যালট পেপার নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়গুলোয় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
পাখতুনখাওয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় সাতটি জেলা (সাবেক কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় এলাকা) থেকে অনেক অভিযোগ এসেছে। এলাকাগুলো পাখতুনখাওয়া প্রদেশের হলেও বাস্তবিক অর্থে তা রয়ে গেছে পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোহসিন দাওয়ার এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, কিছু ব্যক্তি ও সেনাবাহিনীর সদস্য তাঁর নির্বাচনী এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেন।
বর্তমান নির্বাচনের উজ্জ্বল দিক হলো, নারী ভোটার ও প্রার্থীদের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ। এটা এ কারণেই সম্ভব হয়েছে যে নতুন আইনে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিশেষ আসনের বাইরে নিয়মিত আসনগুলোয় অন্তত ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
জাতীয় পরিষদ ও চারটি প্রাদেশিক পরিষদে আসন বিন্যাসের পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে ভোট গণনা শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর। পিপিপি সিন্ধু প্রদেশে জেতার আশা করছে। পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে আসন কাছাকাছি হওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে সব নির্বাচনী লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আসছে গুরুত্বপূর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশে। পাঞ্জাবের ফলাফলই কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও কেন্দ্রীয় সরকার গঠন নির্ধারণ করে দেবে।
আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক বিষয়াদির বিশ্লেষক
সূত্র: প্রথম আলো