মুসাফির রাফি
গতকাল সিলেটে আছেন এমন একজনের সাথে ফোনে কথা বললাম। জানতে চাইলাম, নির্বাচনের অবস্থা কি। তিনি উত্তর দেয়ার আগেই বলে দিলাম, সাধারন মানুষের মত একেবারে নিরপেক্ষভাবে কথা বলবেন। দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে নয়।
তিনি জানালেন, নির্বাচনের অবস্থা, জনগনের মানসিকতা পাল্টাচ্ছে।
তার কথাটি রহস্যময় মনে হলো আমার কাছে। আমি বললাম, বুঝলাম না, কে জিতবে? আরেকটু পরিস্কারভাবে বলেন।
তিনি জানালেন, প্রথমদিকে মানুষ অনেকটা গতানুগতিক চিন্তা নিয়েই ছিল। আওয়ামী লীগের নৌকা বা বিএনপির ধানের শীষের মধ্যেই ছিল খেলাটা। এর বাইরে অন্য কোন অপশন খুব একটা মাথায়ও ছিলনা তাদের।
কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে অনেকটাই। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই টেবিল ঘড়ি মার্কা নিয়ে এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের এসে গেছেন আলোচনায়। জামায়াত-শিবিরের লোক হয়তো একটু বেশী উৎসাহী তাকে নিয়ে কিন্তু একেবারে দল নিরপেক্ষ কিংবা বড় দুই দলের সমর্থকরাও এখন তাকে সমীহ করতে শুরু করেছে।
সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিত, আইনসম্মত ও নান্দনিক নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়ে এডভোকেট জুবায়ের এখন অনেকটাই গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছেন সর্বমহলে। নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ ও শাস্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে থাকলেও এক্ষেত্রে টেবিল ঘড়ি পুরোপুরি ব্যতিক্রম।
শিক্ষিত ও মার্জিত মানসিকতার হওয়ায় শিক্ষিত মহলেও এডভোকেট জুবায়ের এখন জনপ্রিয়।
তিনি আরো বললেন, জুবায়ের সাহেবকে বিএনপি সমর্থন না দিলেও ২০ দলের প্রার্থী হিসেবে তাকেই জনগণ মনে করছে কেননা জোটের শরীক বাকি সব দলই টেবিল ঘড়ির প্রতি তাদের সমর্থন ইতোমধ্যেই ব্যক্ত করেছে। এমনকি কওমী ও আলিয়া মাদ্রাসার একটি বিরাট অংশ যারা কিনা সিলেটের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর তারাও এডভোকেট জুবায়েরকেই তাদের প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আমার সব শুনে মনে হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসলে ঘটে যেতে শুরু করেছে। বিগত স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতের সমর্থক প্রার্থীরা ব্যপক ভাল ফলাফল করেছে। যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা এটাই যে, বিএনপির চেয়েও বেশী সংখ্যক ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াত থেকে নির্বাচিত হয়েছে। তার মানে জামায়াত জনপ্রিয়তার দিক থেকে বড় দুই দলের ঘাড়ে নি:শ্বাস ফেলতে শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। তার চেয়ে বড় কথা, বিগত ১০ বছরের এত জুলুম নির্যাতনের পরেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা মাঠ ছেড়ে পালায়নি। জনগণের সাথে তাদের সম্পৃক্ততাও ছিল। ফলে নির্বাচনে জনগণ জামায়াতের পাশে দাঁড়াতে ভুল করেনি। আর সরকারের জুলুম নিপীড়ণ বা মিডিয়ার জামায়াত বিরোধী প্রচারণাও জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। বরং স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল জামায়াতের পক্ষে যাওয়ার একটা বড় কারণ হলো জামায়াতের প্রতি জনগণের সহানুভুতি আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
সিলেটের নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর অংশগ্রহন রাজনৈতিকভাবেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজশাহী ও বরিশালে জামায়াতের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা হয়রানি হচ্ছেন, বিএনপি এখনো অবধি সে ব্যপারে কোন সহানুভুতি দেখায়নি। এর আগে গাজীপুরেও জামায়াতের মেয়র প্রার্থী তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার সাথে সাথেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। এসব হয়রানির দায় বিএনপিরও কম নয়, কেননা বিএনপিকে সমর্থন দেয়াতেই এই নিরীহ মানুষগুলোকে হয়রানি করা হয়েছে, হচ্ছে। রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, রাজশাহীতে সিটি নির্বাচনে এখনো পর্যন্ত জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মী একসাথে প্রচারণায় নামতে পারেনি। রাজশাহী জেলা ও মহানগরীর জামায়াতের প্রায় সকল নেতা এরই মধ্যে গ্রেফতার হলেও বিএনপি তার কোন প্রতিবাদ করেননি। এই অবস্থায় জামায়াতের একটা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া তার নিজ নেতাকর্মীর আত্মবিশ্বাসের জন্যই প্রয়োজন ছিল। সিলেটে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়ে জামায়াত তার জনশক্তির চাাহিদার প্রতি সম্মান জানিয়েছে।
জামায়াত নিয়ে এতদিন আরেকটা কমন পাবলিক পারসেপশন এমন ছিল যে জামায়াত শুরুতে নির্বাচনে প্রার্থী দেয় আর পরে বিএনপির চাপে পড়ে তা প্রত্যাহারও করে নেয়। সিলেট নিয়ে বিএনপির নেতারা ও বিএনপিমনা বুদ্ধিজীবিরা জামায়াতকে কম চাপ দেয়নি। নানা ধরনের কটু কথা বলে কম প্রভাব সৃষ্টি করেনি। এমনকি সরকারের সাথে আঁতাত করার পরিকল্পিত অভিযোগও আনা হয়েছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে।
জামায়াত এখনও পর্যন্ত সেই সব অভিযোগ বা সিন্ডিকেটেড প্রচারণার কোন নোংরা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি যা সিলেটসহ গোটা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেই একটি ইতিবাচক ইমেজ তৈরী করেছে। আর সিলেটে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার শেষ দিনও পেরিয়ে গেছে অনেক আগে, কিন্তু জামায়াত প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেনি বরং আগের চেয়ে জোরেশোরে এডভোকেট জুবায়ের তার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ তাহের সিলেট নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছেন, জামায়াত থাকলে সিলেটে জুবায়েরও প্রার্থী থাকবে। জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমানও সিলেটে গিয়ে এডভোকেট জুবায়েরের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। এতে প্রমাণ হয়েছে যে, জামায়াত তার দলীয় ও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই সিলেটে নির্বাচন করছে। তাছাড়া নির্বাচনী প্রক্রিয়াগতভাবেও এডভোকেট জুবায়েরের প্রার্থীতা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই আর।
বাস্তবতা হলো, জামায়াতের এই নির্বাচনে অটল হয়ে টিকে থাকার সিদ্ধান্তকে সাধারণ জনগণ সমর্থন জানিয়েছে ব্যপকভাবেই। তাই, জামায়াত নির্বাচনে আছে, দিন দিন এই বিষয়টা যত পরিস্কার হচ্ছে ততই যেন এডভোকেট জুবায়ের আর টেবিল ঘড়ির পক্ষে জনমত বাড়ছে। আসছে ৩০ জুলাই এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রচলিত ঘুনে ধরা রাজনীতিকে প্রত্যাখান করে বিকল্প প্রার্থী, সজ্জন ও নিখাদ ভাল মানুষ, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকেই বেছে নিবে, সিলেটের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেদিকেই ইংগিত করছে।