মাসুম খলিলী
পাকিস্তানের নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে জনমতে নাটকীয় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আগামী ২৫ জুলাই ২০১৮ সালের এই নির্বাচনে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তা নিয়ে এখন জোর জল্পনা চলছে? তবে এর মধ্যে জনমত পরিবর্তনের ধারাটি পাকিস্তানের বিশ্ব কাপ জয়ী ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানের অনুকুলে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
গত মাস পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছিল এবারের নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ সম্ভবত অধিক আসনে জয় পেতে যাচ্ছে। জুলাইয়ের চার তারিখের গ্যালপ পাকিস্তানের জরিপে দেখা যায় মুসলিম লীগ ও পিটিআই এর জন সমর্থন ২৬ ও ২৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য একটি জরিপ সংস্থা কাছাকাছি সময়ে ইমরান খানের পিটিআই ৩০ ভাগ এবং নওয়াজের মুসলিম লীগ ২৭ শতাংশ সমর্থন পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে।
অবশ্য ভোটারের সমর্থন দিয়ে আসন প্রাপ্তি সব সময় বিচার করা যায় না বৃটিশ কেন্দ্রীক সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তির ভিত্তিতে জয় নির্ধারণ করার ব্যবস্থায়। ফলে আসন ভিত্তিক জয়ের সম্ভাবনা যাচাই না করলে নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল যাচাই করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ ধরনের একটি জরিপ প্রকাশ করেছে নিরাপত্তা সংস্থা একেডি। তাদের জরিপ অনুসারে মোট ৩৪২ টি আসনের পাক সংসদের যে ২৭২ টি সাধারণ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ( অবশিষ্ট ৭০ টি আসন মহিলা ও জাতিগত সংখ্যালঘু প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত) তার মধ্যে প্রধান দলগুলোর কেউই সামগ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হবে না। এতে একটি জোট গঠন করেই ক্ষমতায় যেতে হবে বিজয়ী দলকে।
এই জরিপ অনুসারে নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো ফল করবে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল)। জরিপ অনুযায়ী ২০১৩ সালে পাওয়া ২৭ আসন থেকে বেড়ে পিটিআইয়ের আসন সংখ্যা ৯৯ টিতে উন্নীত হতে পারে। অন্য দিকে গত নির্বাচনে ১৪২ টি আসনে জয়ী হওয়া নওয়াজের পিএমএল ’র আসন এবার নেমে আসতে পারে ৭২ টিতে। বাস্তব ফল যদি এ রকম হয় তাহলে সম্ভবত পিটিআই পিএমএল, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এমএমএ সহ বিভিন্ন দলের মধ্যেএকটি জোট সরকার পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেবে।
এবারের নির্বাচনের ব্যাপারে একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল। তিনি কিভাবে ইমরান খান অধিক আসনে জয় পাবেন তার একটি দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন। বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চল এবং অন্য প্রদেশের সম্ভাব্য আসন জয়ের বিন্যাস দেখিয়ে তিনি বলেছেন, পিটিআই সম্ভবত ৯০-৯৫টি আসন পাবে, ১০০টির বেশিও পেতে পারে। পিএমএল (এন) পেতে পারে ৫০-৬০টি। পিপিপি সর্বোচ্চ পাবে ৩৫-৩৬টি। নির্বাচনের পর ২৫-৩০ জন স্বতন্ত্র পিটিআইয়ে যোগ দিলে জিডিএ, পিএসপি এমনকি এমকিউএম (পি) নিয়েও পিটিআই কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে পারবে।
একটি খসড়া জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে ইকরাম সেহগাল বলেছেন, পাঞ্জাব যুদ্ধক্ষেত্রে জাতীয় পরিষদে বিভাগওয়ারি আসন বিভক্তি হবে এভাবে: ১. রাওয়ালপিন্ডি (অটক, চকওয়াল, ঝিলাম) মোট আসন ১৩টি (পিটিআই ৬, পিএমএল এন ৪টি, পিপিপি ১, স্বতন্ত্র ২), ২. সারগোদা (মিয়াওয়ালি, খুশাব, বাক্কার) ১১টি আসন (পিটিআই ৫, পিএমএল এন ২, পিপিপি ১, স্বতন্ত্র ৩), ৩. ফয়সালাবাদ (তোবা তেক সিং, জং, চিনিয়ট) ১৮ আসন (পিটিআই ৬, পিএমএল এন ১১, পিপিপি ১), ৪ গুজরানওয়ালা (গুজরাট, মান্ডি বাহাউদ্দিন, নরোওয়াল, সিয়ালকোট, হাফিজাবাদ) ২০ আসন (পিটিআই ৬, পিএমএল এন ৮, পিপিপি ১, স্বতন্ত্র ৫), ৫. লাহোর (কাসুর, শেখপুরা) ২৪ আসন (পিটিআই ১২, পিএমএল এন ১২), ৬. সাহিওয়াল (ওকারা, পাকপাতন) ১০ আসন (পিটিআই ৩, পিএমএল এন ৫, স্বতন্ত্র ২), ৭. মুলতান (লোধরান, বেহারি, খানেওয়াল) ১৬ আসন (পিটিআই ১১, পিএমএল এন ২, পিপিপি ১, স্বতন্ত্র ২), ৮. বাহাওয়ালপুর (বাহাওয়ালনগর, আর ওয়াই খান) ১৫ আসন (পিটিআই ৮, পিএমএল এন ৫, পিপিপি ১, স্বতন্ত্র ১), ৯. ডিজি খান (লেহ, মুজাফফরনগর, রাজনপুর ) ১৫ আসন (পিটিআই ১০, পিএমএল এন ২, স্বতন্ত্র ৩)। অর্থাৎ পিটিআই ৬৭, পিএমএল (এন) ৫১, স্বতন্ত্র ১৮টি আসন পাচ্ছে। এমএমএ পাচ্ছে ৩ আসন।
কেপিকেতে ৩৯টি জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে পিটিআই ২৩টি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পিএমএল (এন) ৪টি, এমএমএ ৪টি, পিপিপি ৩টি, এএনপি ২টি, স্বতন্ত্র ৩টি পেতে পারে।
সিন্ধুর ৬১টি আসনের মধ্যে পিটিআই ৪টি, পিএমএল (এন) ২টি, পিপিপি ২৬টি, জিডিএ ৭টি, পিএসপি ১০টি, এমকিউএম ৮টি, এমএমএ ৪টি পেতে পারে।
বেলুচিস্তানের ১৪টি জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে পিটিআই ১, এমএমএ ৩, পিকেএমএপি ৪, বিএপি ২, পিএমএল (এন) ১, এনপি ১, বিএনপি ১ ও স্বতন্ত্র ১টি আসন পেতে পারে।
ইকরাম সেহগালের মতে, ব্যালট বাক্স কারসাজিতে ২০১৩ সালে শাহবাজ ‘নির্বাচনী জাদু’ দেখিয়ে জাতীয় পরিষদে ৩০-৩৫টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এর ফলে তারা সংরক্ষিত নারী আসনও বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। এতে করে আরো কিছু স্বতন্ত্র সদস্য পিএমএলে (এন) যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সেটি কাজ করবে না, ফলে তারা হেরে যাবে। এটি কাজ না করার কারণগুলো হচ্ছে:
১. ওই সময়ের প্রাদেশিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদেরকে কৌশলের আশ্রয় নিতে অবাধ সুযোগ দিয়েছিল ।
২. নওয়াজ শরিফের অনির্বাচিত উপদেষ্টারা ও শাহবাজ শরিফের ডিজিএম অফিসারদের ঘনিষ্ঠ মহলের কারণে শরিফদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন কেবল নওয়াজ শরিফের ক্যারিশমাই তাদের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।
৩. পিএমএলের (এন) ৩০-৩৫ জন এমএলএ জাতীয় পরিষদে এখন স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন। এছাড়া আরো ৩৫-৪০ জন দলত্যাগ করে প্রধানত পিটিআইয়ে যোগ দিয়েছেন।
৪. দক্ষিণ পাঞ্জাবে ২২ জন এমএনএ দলত্যাগ করে জোট বেঁধে পিটিআইয়ে যোগ দিয়েছে এতে করে সেখানে পিএমএলের (এন) বড়জোর ৫টি আসন রয়েছে।
৫. উচ্চতর আদালতের প্রতি নওয়াজ শরিফের আক্রমণ দোটানায় থাকা ভোটারদের পিএমএলের (এন) বিরুদ্ধেই নিয়ে গেছে, এমনকি লাহোরের শক্ত দুর্গেও তা ঘটেছে।
৬. ইমরান খান এলিট ভোটারদের ত্যাগ করলেও তারা নওয়াজ শরিফকে ভোট দেবে না, তারা ভোট দানে বিরত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।
৭. ‘খাতেমুন নবুওয়াত’ কেলেঙ্কারি টিএলপিকে আরো ভোট দেবে, আগে যারা পিএমএল (এন)কে ভোট দিত, তাদের অনেকে এবার টিএলপিকে ভোট দেবে।
৮. নওয়াজ শরিফের কাছে ‘বিক্রি’ হওয়া টিভি অ্যাঙ্করদের প্রতি জনক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
৯. সেনাবাহিনীর ওপর পিএমএলের (এন) আক্রমণ করার পরামর্শ যথাযথ ছিল না, বিশেষ করে উত্তর পাঞ্জাবে প্রায় প্রতিটি পরিবারে অবসরপ্রাপ্ত বা সক্রিয় সৈন্য রয়েছে। তারা কেউ মোদির প্রতি নওয়াজের ভালোবাসাকে পছন্দ করে না। এমনকি ১০ ভাগ ভোট যদি বদলে যায়, তবুও পিএমএলের (এন) জন্য নির্বাচনী বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
ইমরান খান দলের ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং “ধর্মীয় বৈষম্য” ছাড়াই সব পাকিস্তানির জন্য কাজ করার অঙ্গিকার করেছেন। এসব এবার ভোটারদের ভালোভাবেই আকর্ষণ করছে বলে মনে হয়।
তবে পিটিআইয়ের পক্ষে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য বিচার বিভাগ, সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে মুসলিম লীগের। তাদের অভিযোগ হলো ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী করতে নওয়াজ শরীফকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
সাবেক ক্রিকেটার থেকে এখন রাজনীতিবিদে পরিণত এই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নানা সমালোচনাও রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এখন তৃতীয় স্ত্রীর সাথে রয়েছেন। প্রথম স্ত্রী বৃটিশ ধনকুবের কন্যা জেমাইমা পাকিস্তানের সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে উঠতে না পেরে তার সংসার ত্যাগ করেছেন। দুটি পূত্র সন্তান রয়েছে তার গর্ভের। দ্বিতীয় স্ত্রী রেহাম খানের সাথে ইমরানের সংসার ছিল ১০ মাসের। এই ক্ষণস্থায়ী ইমরান স্ত্রী এবারের নির্বাচনের আগে একটি বই লিখে ইমরান বহু অনানুষ্ঠানিক সন্তানের জনক বলে দাবি করেছেন। ইমরানই নাকি তাকে বলেছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে বয়সি সন্তানের বয়স ৩৪।
পিটিআই অবশ্য এসবকে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য প্রতিপক্ষের উদ্যেশ্যমূলক প্রচারণা বলে উল্লেখ করেছে। ইমরানের তৃতীয় স্ত্রীকে আপাদমস্তক ঢাকা এক নারী পীর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর এটি তার শেষ ইনিংস বলে দাবি করেন ইমরান খান। আগের সংসারে এই নারীর গোটা পাঁচেক সন্তান রয়েছে। এসব ব্যক্তিগত বিষয় আসয়ের প্রভাব কতটা নির্বাচনে পড়বে সেটি অবশ্য নিশ্চিত নয়।
তবে সার্বিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে ইমরান খাান পাকিস্তানে পরবর্তী সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। যদিও শাহবাজ শরীফ এর মধ্যে সেনা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি বড় ভাইয়ের সৃষ্ট তিক্ততা কতটা কাটাতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।