বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ‘মাতা’ খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না। অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে, নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং সেনা মোতায়েন করে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।
রাজধানীর গুলিস্তানের ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চের সামনে আজ সোমবার সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিএনপি অনশন কর্মসূচি পালন করে। কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে এই কর্মসূচি পালিত হয়। বিকেলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে পানি খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করান।
আজকের অনশনে ঢাকা মহানগর বিএনপির বিভিন্ন ইউনিটের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল থেকে বিএনপির নেতা–কর্মীরা মহানগর নাট্যমঞ্চে জড়ো হতে থাকেন। পরে নেতা–কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জ্যেষ্ঠ নেতারা এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা কার্পেটর ওপর বসে অনশন করেন। দুপুরের পর থেকে নেতা-কর্মীদের ভিড় কমতে থাকলেও অনশন স্থানের আশপাশে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ভিড় দেখা গেছে।
বিএনপির এর আগের অনশন কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছিল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ওই অনশন কর্মসূচি থেকে বেশ কয়েকজন নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করে সাদাপোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ। আজকের অনশন কর্মসূচি ঘিরে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকলেও বিএনপির কর্মসূচিতে কোনো ধরনের বাধা দেয়নি। এ ছাড়া কোনো ধরনের আটক কিংবা গ্রেপ্তারের খবরও পাওয়া যায়নি।
অনশন কর্মসূচিতে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি কিছু সময় অনশনস্থলে থেকে চলে যান। অনশনে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার ও জাগপার সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদওয়ান আহমেদ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান খলিকুজ্জামান ও সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমদ সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
অনশন কর্মসূচির সভাপতির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার খালেদা জিয়াকে তাঁর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না। তাঁকে সুচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। সারা দেশে বিএনপির অসংখ্য নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসবের উদ্দেশ্য একটাই, খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তিনি আরও বলেন, ‘সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।’
বিএনপির আজকের কর্মসূচিতে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং ২০–দলীয় জোটের শরিক দলের প্রায় সব দলের নেতার বক্তব্যে একটি বিষয় উঠে এসেছে। নেতারা বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা না গেলে রাজপথে নেমে তাঁকে মুক্ত করা হবে। খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি ও ২০–দলীয় জোটের কেউ জাতীয় নির্বাচনে যাবে না। জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখা হবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজকের এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তিনটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচন হবে না। হতে দেওয়া হবে না। খালেদা জিয়া দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। গণতন্ত্রের জন্য খালেদা জিয়া আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তাই তাঁকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। তিনি বলেন, সরকার ২০১৪ সালের মতো আরও একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়। সে অনুযায়ী সরকার একটি নীলনকশা করেছে। এই নীলনকশা আরেকবার বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। আইনিভাবে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা না গেলে রাজপথে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করতে হবে। তাঁকে মুক্ত করে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার অন্যতম আইনজীবী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, বিএনপির আইনজীবীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করে আনার জন্য। কিন্তু সেখানে বড় প্রতিবন্ধকতা আছে। উচ্চ আদালত যেখানে খালেদা জিয়াকে জামিন দিচ্ছেন, সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করছেন। নিম্ন আদালত সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলছে। যার কারণে খালেদা জিয়ার মামলা বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একদিন না একদিন সরকারের কৌশল-ষড়যন্ত্র অকার্যকর হবে। শিগগিরই তিনি মুক্ত হবেন। যদি আইনি উপায়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে তাঁর মুক্তির একমাত্র উপায় রাজপথ। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন। পরে মওদুদ আহমদ নেতা-কর্মীদের বলেন, ‘হাত তো তোলেন, সময়মতো তো পাওয়া যায় না।’
বিএনপির অনশনরত নেতা-কর্মীদের অনশন ভাঙাতে আসেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার জয় হয়েছে। জেলে থাকা খালেদা জিয়ার জয় হয়েছে। জেলে যাওয়ার আগে তিনি নেতা–কর্মীদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করার কথা বলে গেছেন। এটা শুরু। শেষ সময়ে হলেও সরকার আজকের এই কর্মসূচির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। বিএনপির জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন, কবির মুরাদ, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা হয়। ওই দিন থেকে তিনি পুরান ঢাকার কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো