চলতি বছরের এপ্রিলে জোরালো হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে এখনও কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন খুঁজে পায়নি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আন্দোলনের অন্যতম নেতা মো. রাশেদ খানকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্নভাবে ছায়া তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তবে আন্দোলনের কোনো ধাপে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা কারও ইন্ধন খুঁজে পায়নি তারা। মেলেনি ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগসাজশ।
ফেসবুক লাইভে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা এক মামলায় গত রোববার রাশেদ খানকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। রাশেদ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশেদকে আইসিটি অ্যাক্টে গ্রেফতার করা হলেও তদন্ত চলছে এ আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারী এবং আন্দোলনের পেছনের কলকাঠি নাড়ানো ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় আনতে। রাশেদকে গ্রেফতারের পর তার মোবাইল ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফরেনসিক পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। তবে তদন্তে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ‘কোটা সংস্কার চাই (সব ধরনের চাকরির জন্য)’- ফেসবুকে এমন একটি গ্রুপ ছাড়াও রাশেদ আরও তিনটি ক্লোজড গ্রুপে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের একটির সদস্য (মেম্বার) সংখ্যা ৩০ জন, অপরটিতে ১০ জন। ৩০ জনের ক্লোজড গ্রুপটিতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা রয়েছেন। ১০ জনের গ্রুপটিতেও আছেন সিনিয়র নেতারা। ওই দুই গ্রুপের চ্যাটবক্সের তথ্য যাচাই-বাছাই করে পুলিশ কারও উস্কানি কিংবা রাজনৈতিক ইন্ধনের তথ্য পায়নি। চ্যাটে তারা কথা বলেছেন আন্দোলনের ধরন ও কৌশল নিয়ে। নাশকতা কিংবা ধ্বংসাত্মক কোনো নির্দেশনা সেখানে নেই।
তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিচালনায় অর্থ তোলার জন্য ১৫টি বিকাশ এবং পাঁচটি রকেট অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এ বিষয়ে রিমান্ডে রাশেদ পুলিশকে জানায়, অ্যাকাউন্টগুলো খুলে গ্রুপে নম্বর দেয়া হয়েছে। এটা সবাই জানতো। যে যার মতো করে টাকা দেয়। টাকা সংগ্রহের পর সেই টাকার পরিমাণ গ্রুপে পোস্ট করা হয়। কোনো ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে যাতে না হয় সেজন্য টাকা গণনার ছবিও পোস্ট করা হতো। এখানে লুকোচুরির কিছু ছিল না।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানতে পারেন যে, ওই ২০টি অ্যাকাউন্টে অনেকে টাকা পাঠাতো। লেনদেনের পরিমাণ ছিল খুবই অল্প (১০০, ২০০, ৫০০ এবং সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা)। শুধু একবার তারা এক লাখ ১০ হাজার টাকা পেয়েছিল। কেউ একজন তাদের ইফতার পার্টির জন্য এ খরচ দেয়।
রাশেদ গ্রেফতার এবং পরবর্তী তদন্ত কার্যক্রমে এ আন্দোলনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক কিংবা বিএনপির কোনো নেতার ইন্ধন এখনও পাওয়া যায়নি- এমনটি জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে তারা (তদন্ত কর্মকর্তা) বলেন, যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদের ফেসবুক ইনবক্সে একটি ফেসবুক পেজ থেকে কিছু ম্যাসেজ এসেছিল। পেজটি প্রায়ই সরকারবিরোধী বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে থাকে। তবে রাশেদ সেই ম্যাসেজগুলোতে সাড়া দেয়নি। এছাড়া তারা মোবাইলে দেশের বাইরে থেকে কোনো ফোন কিংবা ম্যাসেজ আসেনি।
ফেসবুক লাইভে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় রাশেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন পাঁচদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। রিমান্ডে রাশেদ জানায়, ফেসবুক লাইভে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে এমন বক্তব্য দেন তিনি।
রিমান্ডে তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে যখন যোগাযোগ করা হয়েছিল তখন একজন নীতিনির্ধারক বলেছিলেন, তোমরা আন্দোলন বন্ধ কর। ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন হবে। প্রজ্ঞাপন না হলে তোমরা ফের আন্দোলনে নেমো। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রজ্ঞাপন না হওয়ায় আমরা আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই। তবে আমাদের গ্রুপে কোনো উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়া হয়নি।’
রিমান্ডে রাশেদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া গেছে কি না- এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স) মো. মাসুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে রাশেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে পাঠানো হবে।’
‘তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা সম্ভব নয়’- বলেও যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর শাহবাগ থানায় রাশেদের নামে মামলটি করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়। ওই মামলায় গত সোমবার তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন যা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এরপরও গত ২৭ জুন রাশেদ খান ‘কোটা সংস্কার চাই’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে ভিডিও লাইভে এসে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মানহানিকর বক্তব্য ও মিথ্যা তথ্য দেন।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত থাকায় তা সংস্কারের জন্য চলতি বছরের শুরুতে আন্দোলনে নামেন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
নানা কর্মসূচি পালনের পর গত ১০ এপ্রিল শাহবাগে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান নেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। রাতে পুলিশ তাদের পিটিয়ে তুলে দেয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হয় সংঘাত; বিভিন্ন হল থেকে আন্দোলনে নেমে আসেন ছাত্রীরাও। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হয় বিক্ষোভ। এরই মধ্যে ঢাবির ভিসির বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
পরের দিন সচিবালয়ে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখার আশ্বাসে প্রতিনিধি দলটি কর্মসূচি এক মাস স্থগিত করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদেরই একটি অংশ আন্দোলনের অটল থাকার ঘোষণা দেয়।
পরে অন্য অংশটিও সরকারকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে রাতে ক্যাম্পাস ছাড়ে।
ওই আন্দোলন থেকে তারা পাঁচটি দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- সরকারি নিয়োগে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, কোটার যোগ্য প্রার্থী না পেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অভিন্ন বয়সসীমা, নিয়োগপরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।
১৫ এপ্রিলের পরও ঘোষণা না আসায় লাগাতার কর্মসূচিতে নামেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ মে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পর আন্দোলন স্থগিত করা হয়। কিন্তু এরপরও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় ঈদের পর সারাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
গত ২৮ জুন ফের কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন ডাক দেন। কিন্তু সেখানে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরসহ অন্তত তিনজন গুরুতর আহত হন।
এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে তা পণ্ড করে দেয় ছাত্রলীগ। আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। অনেক নেতাকে তুলে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ।
পাশাপাশি চলে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর দুই মামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনসহ তিনজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, রাশেদকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় রিমান্ডে নেয়া হয়।
তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ