মাসুম খলিলী
মালয়েশিয়ায় ৬১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা আমনু নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর আবার কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? দেশটির চতুর্দশ সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর ৩০ জুন প্রথম নেতৃত্ব নির্বাচন করতে যাচ্ছে দলটি। এই নির্বাচনকে মনে করা হচ্ছে আমনুর জন্য গুরত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ঘটনা। ক্ষমতার বাইরে থেকে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে সরকারের প্রভাব কাজ করে না বলে এবার দলের শীর্ষ পদে যত প্রার্থি হয়েছেন তার নজীর নিকট অতীতে দেখা যায় না।
সরকারে থাকাকালে অধিকাংশ বার দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছেন বিনা ভোটে। এবার দলের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট আহমদ জাহিদ হামিদীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মাহাথিরকে চ্যালেঞ্জ করা সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কেলানতানের প্রিন্স রেজালাহ হামজাহ কু লি এবং যুব আমনু প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী খাইরি জামাল উদ্দিন। আরো দুজন প্রার্থি রয়েছেন যারা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নন। দলের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হিসামুদ্দিন হোসেন অন এবার নির্বাচনে প্রদ্ধিন্দ্বিতা করছেন না।
রাজনৈতিক দল হিসাবে আমনু মালয় জাতি, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের মর্যাদা তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। মালয় সংস্কৃতিকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে রক্ষা এবং মালয়েশিয়াজুড়ে ইসলামকে সমর্থন, রক্ষা এবং বিকাশের জন্য দলটির ঘোষিত আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। মালয়েশিয়ার সোসাইটি আইন অনুসারে প্রতি বছর আমনুুকে সাধারণ পরিষদের সভা আহ্বান করে নেতৃত্বের ভূমিকা নবায়ন করতে হয়। আর প্রতি পাঁচ বছর পর দলের সর্বোচ্চ ফোরাম নির্বাচন করতে হয়। এই হিসাবে ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল নেতৃত্ব নির্বাচনের কনভেনশন হবার কথা। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে এই কনভেনশন স্থগিত করার জন্য আবেদন করা হলে তা সরকারের রেজিস্ট্রার অব সোসাইটি অনুমোদন করে। এই অনুমোদন বৈধ হয়নি বলে বিতর্ক রয়েছে।
আগামী ৩০ জুন আমনুর সেই স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমনু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই নির্বাচন হলে নি:সন্দেহে বলা যেত যে ড. আহমদ জাহিদ হামিদী আমনুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। কিন্তু একদিকে আমনুর প্রবীণ নেতা রেজালাহ হামজাহ অন্য দিকে উদীয়মান আমনু নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বাদাবির জামাতা খাইরির চ্যালেঞ্জের কারণে সহজে তিনি দলীয় প্রধান হবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
আমনুর এবারের নেতৃত্ব নির্বাচন কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। এবারের নির্বাচনে নির্ধারিত হবে দল কোন পথে এগুবে সেটি। পরের নির্বাচনের উপর যার প্রভাব পড়বে অনিবার্যভাবে।
মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুর রাজ্জাক বারিসান ন্যাশনালের বর্তমান জোট গঠন করেছিলেন। তখন আমনু যেমন সংখ্যাগরিষ্ট মালয়দের কার্যকর প্রতিনিধিত্বকারী দল ছিল তেমনিভাাবে বারিসানের শরীক দল এমসিএ, এমআইএ, জারেকান অথবা সাবাহ সারওয়াকের আঞ্চলিক দলগুলো স্ব স্ব জাতি বা জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল ছিল। চতুর্দশ সাধারণ নির্বাচনে সেটি আর থাকেনি। এই নির্বাচনে আমনু আসন লাভ করে ৫৪টি আর দুটি আসন পায় চীনা ও ভারতীয় জাতিতাত্বিক বারিসান শরীক দলগুলো। ৭৯ আসনের বাকিগুলো লাভ করে সাবাহ সারওয়াকের আঞ্চলিক দলগুলো। এসব দল অবশ্য ইতিমধ্যে বারিসান জোট ত্যাগ করেছে।
এবার একটি গুরুত্বপুর্র্ণ প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমনুকে জাতি ভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসাবে রাখা হবে নাকি দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাফর অন আমনুকে বহু জাতিভিত্তিক দলে পরিণত করার যে সুপারিশ করেছিলেন সেটিকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাবে দলটি। এ সিদ্ধান্ত নিতে হলে দলের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার আনার প্রয়োজন রয়েছে।
এই সংস্কার আনতে হলে যে ধরনের নেতৃত্ব নির্বাচন দরকার সেটি কতটা এবার আসবে সেই সংশয় কিছুটা রয়ে গেছে। দলে সংস্কার ও নতুন চিন্তার কথা রেজালাহ হামজাহ বলছেন। তিনি মনে করেন, আমনুকে সঠিক ধারায় আনতে হলে সেটাকে গাইড করার মতো চিন্তাশীল ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য তিনি দলের দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন। অন্য দিকে জাহিদ হামিদীও সংস্কার চান এবং এর মধ্যে তিনি আমনুকে টাকা ও যুদ্ধবাজ ধরনের লোকদের কবল থেকে মুক্ত রাখার কথাও বলেছেন। তবে তিনি আমনুকে অন্য জাতির জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষে নন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন জাফর অনের প্রস্তাব আমনু গ্রহণ করেনি। আর তিনি তখন আমনু ছেড়ে অন্য দল সংগঠিত করেছিলেন।
নাজিবের আমলের দলের অন্যতম প্রধান কান্ডারি ছিলেন হামিদী। ফলে দলের বিপর্যয়ের দায় তাকেও নিতে হবে বলে যুক্তি দেখান তার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থিরা। খাইরি জামালুদ্দিন একসময় মাহাথির পূত্র মুখরিজকে হারিয়ে যুব আমনুর প্রধান হয়েছিলেন। এখনো সে পদে তিনি বহাল রয়েছেন। তিনি দলকে মালয়েশিয়ার সব জাতির প্রতিনিধিত্বশীল করে গড়ে তুলতে চান।
শুধু জাফর অনই নন পিকেআর এর কার্যকর নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দল গঠনের সময় এটি উপলব্ধি করে তার দলকে সব জাতির জন্য উন্মুক্ত করেছেন। দুই দশক পর সেই বিষয়টি আমনুতে গভীরভাবে উপলব্ধি করা হচ্ছে। খাইরি এই ধারণাকে দলের মধ্যে কতটা গ্রহণীয় করতে পারেন সেটিই হলো দেখার বিষয়।
আমনুর নেতৃত্ব নির্বাচনে এবার কি হতে যাচ্ছে সেটি আনুমান করা কিছুটা কঠিন। প্রথম দিকে জাহিদ হামিদীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। হামিদী যখন প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের সাথে সাক্ষাত করতে যান তখন মাহাথির নাকি তাকে রেজালাহ হামজার কাছে দলের প্রধানের পথ ছেড়ে দিয়ে আরেক মেয়াদ ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদে থেকে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। হামিদী সেটি গ্রহণ করেননি। পরে রেজালাহ হামজার প্রার্থি হবার ঘোষণা আসে। আর একেবারে শেষমুহূর্র্তে প্রার্থি হবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন খাইরি জামালুদ্দিন।
খাইরি প্রার্থি হওয়ায় কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন কু লি। কারণ তাকে প্রার্থি হবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন খাইরি নিজে। এ কথা কু লি বললে খাইরি তা স্বীকার করে বলেন কাউকে উদ্ভুদ্ধ করলে যে তিনি নিজে প্রার্থি হতে পারবেন না এমনটা তো ঠিক নয়। বোঝাই যাচ্ছে এখানে একটি চাল চেলেছেন বাদাবি জামাতা খাইরি। যুব প্রধান থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট বা ডেপুটি প্রেসিডেন্ট না হয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন তিনি।
তিনি হয়তো মনে করেছেন জাহিদ হামিদী ও কু লি প্রার্থি হলে সিনিয়রদের সমর্থন বিভক্ত হবে আর যুবকদের সমর্থন নিশ্চিত করে তিনি দলের প্রধান নির্বাচিত হবেন।
খাইরি আমনু প্রধান হওয়াটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। তিনি নির্বাচনী বিপর্যয়ের দায় ভার যে নাজিবের পাশাপাশি জাহিদ হামিদীর উপর চাপাচ্ছেন সেটি আমনুতে বড় একটি অংশ সমর্থন করে। ফলে শেষ পর্যন্ত আমনুর নেতৃত্ব নির্বাচনে অঘটন ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। খাইরির অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং ডায়নামিজম সম্পর্কে যারা অবহিত তারা এ ব্যাপারে বেশ আস্থা রাখেন।
বাদাবি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার বৈরি পরিস্থিতিতে তিনি যুব আমনুর সভাপতি হন। আর ঐতিহ্যগতভাবে যুব আমনুর সভাপতি মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া সত্বেও তিনি শুরুতেই বঞ্চিত হন। তার স্থলে মন্ত্রী করা হয় বিজিত যুব আমনু সভাপতি প্রার্থি মুখরিজ মাহাথিরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেই বাধা কেটে উঠে প্রথম প্রতিমন্ত্রী এবং পরে পূর্ণ মন্ত্রী হন। আর এখন যুব বয়সেই আমনুর প্রেসিডেন্ট হবার জন্য প্রার্থি হয়েছেন।
আমনুর ভবিষ্যৎ মালয়েশিয়ায় শেষ হয়ে গিয়েছে সেটি কেউ মনে করেন না। তবে এই ভবিষ্যতের কিছুটা নির্ভর করে পাকাতান হারাপান সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর আর বাকিটা নির্ভর করে দল হিসাবে পূনর্গঠনের পর মালয়েশিয়ানদের আস্থা কতটা অর্জন করতে পারে তার উপর।
বিগত নির্বাচনে পাকাতান হারাপান আগের বারের চেয়ে দুই শতাংশের মতো কম ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে সরকার গঠন করেছে। আর আমনুর ভোট এক তৃতীয়াংশ কমে যাওয়ায় তারা বিপর্যস্থ অবস্থায় বিরোধি পক্ষে যেতে বাধ্য হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া ভোটের বড় অংশটাই ছিল মালয় ভোট। এর মূল অংশ গেছে পাকাতান হারাপানে আরেকটি অংশ গেছে পাসের পক্ষে।
পাসের সাথে ইস্যু ভিত্তিক ঐক্য হতে পারে আমনুর যা পরের নির্বাচনে নির্বাচনী ঐক্যে রূপ নিতে পারে। আর এটি হলে তা পাকাতান হারাপান সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। এসব কিছুর জন্য আগামী পৌনে ৫ বছর বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে এ পথ তৈরি করার জন্য এবারের নতুন আমনু নেতৃত্ব নির্বাচনের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।
আর এক্ষেত্রে যুব জাগরণের যে স্বপ্ন খাইরির বক্তব্যে ফুটে উঠছে সেটি আমনুর মধ্যেও কোন সুনামি নিয়ে আসে কিনা সেদিকে তাকিয়ে আছেন অনেকে।