অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
লন্ডনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘন নিয়ে করা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যানেল ফোরের প্রধান সংবাদদাতা এলেক্স থমসন শেখ হাসিনাকে সেই প্রশ্নটি করেছিলেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে এলেক্স থমসন শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, “আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে যে আপনার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন”? শেখ হাসিনা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোরে এলেক্স থমসনের করা পুরো প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করে লেখ্য রুপ করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে দিন জুড়ে আরো একটি অভ্যর্থনার(শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ) ব্যবস্থা হয়েছিল ব্রিটেনের এই রাজপথে।
কিন্তু একটি বিষয় আছে তা হচ্ছে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর এই বিক্ষোভকারীদের তো অবশ্যই, একই সাথে সে সকল মানবাধিকার গ্রুপ এবং দাতব্য সংস্থারও ধারক যারা দাবি করে আসছে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশে রেকর্ড সংখ্যক বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম ও একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে।
এখানকার শত শত বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছু এমন মানুষ ও রয়েছেন যাদের খুব কাছের প্রিয়জনদেরকে হয় রাস্তা থেকে অথবা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এরপর আর তাদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের খালাত ভাই রাসেল শাহরিয়ার এর জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই দায়ী করেছেন। তার সরকার যেহেতু ক্ষমতায় আছে তাই প্রতিটা গুম, দূর্নীতির ১০০ ভাগ দায় ব্যাক্তিগতভাবে হাসিনাকেই নিতে হবে। মানবাধিকারের বিষয়টাও? অবশ্যই, মানবাধিকারের বিষয়টাও তারই দায়িত্ব।
উন্নয়ন বিষয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনে বক্তৃতা দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আজ বিকেলে লন্ডনে পৌঁছেছেন। আমরা তাকে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম যা অধিকাংশ বাংলাদেশীদেরই প্রশ্ন।
সাংবাদিক: আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো আপনার সরকারের সময় মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে অভিযোগ করে আসছে, যা বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
(এই প্রশ্নের জবাব প্রধানমন্ত্রী দেননি। শেখ হাসিনাকে ইতস্তত দেখে প্রশ্ন উত্তর প্রোগ্রামের সঞ্চালক ঐ প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই অন্য সাংবাদিকের প্রশ্নের দিকে চলে যান।)
সাংবাদিক: আপনি আমার প্রশ্ন নিচ্ছেন না!
সঞ্চালক: একটা প্রশ্ন নিয়েছি, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হবে। ঐ দিকে হাত তুলেছেন…।
সাংবাদিক: প্রধানমন্ত্রী আপনি এই প্রশ্নের উত্তর দিন, আমি নিশ্চিত আপনি এর উত্তর দিতে পারবেন না। আপনি আমাদের এই প্রশ্নটি করার সুযোগ দিচ্ছেন না।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশের লজ্জা আজ ইউকের হৃদয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সালমান আযমী তার ভাইয়ের ছবিগুলো পর্যবেক্ষন করছিলেন, যাকে আজ থেকে দেড় বছর আগে রাজধানী ঢাকা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল।
সালমান আল আযমী: “অপহরণকারীরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেছিল। তারা ভেতরে এসেছিল সন্ত্রাসীদের মত করে, প্রত্যেকে যেন একেকজন সন্ত্রাসী। বাসার দারোয়ানকে তারা নির্মমভাবে প্রহার করেছিল। এটা ছিল একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি। তারা তাকে একটা রুমে পায় এবং একটি কারে করে চোখ বেঁধে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাকে আর পাওয়া যায়নি। এককথায় তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তাকে সম্পূর্ণরুপে গুম করে ফেলা হয়েছে।”
আপনি যদি ব্রিটেনে একটু ঘোরাঘুরি করেন তবে এমন আরো অনেক ঘটনা পাবেন। আমরা আবরার ইলিয়াসের সাথে লন্ডনে দেখা করি। তার বাবা(ইলিয়াস আলী) বিরোধীদলের এমপি ছিলেন যাকে প্রায় ৬ বছর আগে গুম করা হয়েছে।
আবরার ইলিয়াস: “সেদিন রাতে একটা সাদা ভ্যান আমাদের গাড়ীর সামনে এসে থেমেছিল এবং আমি দেখলাম যে আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি দেখলাম কিছু লোক আমার বাবাকে একইসাথে আমাদের ড্রাইভারকেও তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে আমাদের গাড়িটা রাস্তার মাঝখানে খোলা পড়ে রইল।”
এই শহরেরই আরেকজন রাসেল শাহরিয়ার। সে বর্ণনা দিচ্ছে তার খালাত ভাই আরেক বিরোধী দলীয় নেতার(গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন)। যাকে সে সর্বশেষ দেখেছিল ডিসেম্বর ২০১৩ তে।
রাসেল শাহরিয়ার: “তারা একটি নির্মানাধীন ভবনের সামনে বসেছিল হঠাৎ র্যাব সদস্যরা এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। একই সময়ে ৫ জন অর্থাৎ আরো ৪ জনকে তুলে নিয়ে যায় তারা। দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হলেও সত্য যে এখনো আমরা জানিনা সে কোথায় আছে।”
ঠিক এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাথেই রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্ক। হ্যাম্পসটন ও কিলবার্নের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক হচ্ছেন তার ভাগ্নি। টিউলিপ সিদ্দিক এমপি দাবি করেন নির্বাচিত হওয়ার আগে একসময় তিনি আওয়ামীলীগের জন্য কোন বিনিময় ছাড়াই কাজ করেছেন এবং একবার তিনি তাকে আওয়ামীলীগের মুখপাত্র বলেও দাবি করেছিলেন। এমনকি তার মতে আওয়ামীলীগের সহায়তার কারনেই তিনি লন্ডনে তার নির্বাচনে জয়ী হতে পেরেছিলেন।
‘আপনাদের সহায়তা ছাড়া আমি কখনোই ব্রিটিশ এমপি হিসেবে এখানে দাঁড়াতে পারতামনা।’(ভিডিওতে টিউলিপ সিদ্দিকের পুরনো বক্তব্য)
সংবাদপত্রকে জানান তিনি তার আন্টির সাথে পারিবারিক বিষয় ছাড়া রাজনৈতিক কোন বিষয়ে কোন আলোচনা করেন না। যদিও মস্কোতে পুতিনের সাথে সাক্ষাৎকারে এবং এখানকার প্রায় সকল রাজনৈতিক সফরে তাকে শেখ হাসিনাকে সঙ্গ দিতে দেখা গেছে। টিউলিপ এমপি তাকে একজন বৈশ্বিক মানবাধিকার কর্মী বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। নিশ্চিতভাবেই তিনি এখানে সহায়তা করতে পারেন।
সালমান আল আযমী: “আপনি এক ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষায় চ্যাম্পিয়ানের ভূমিকায় আবার অন্য ক্ষেত্রে যেখানে আপনার প্রভাব খাটানোর সুযোগ আছে সেখানে একেবারেই নিশ্চুপ কিভাবে থাকতে পারেন?”
তিনি তার ভায়ের বিষয়ে সরাসরি সহায়তা করার বিষয়ে জানতে টিউলিপের সাথে কথা বলতে অনেক লবিং করেছেন। এমনকি পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমেও চেষ্টা করেছেন।
গত ৩ মার্চ সালমান আযমী টিউলিপকে চিঠিতে লিখেন-
“আমি আপনার সংসদীয় দলের একজন নই এবং আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি শুধুমাত্র সংবিধানের আলোকেই আপনি কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। যাই হোক আমি আপনার কাছে মানবিকতার খাতিরে আবেদন করছি যার কারণ বাংলাদেশ সরকারের সাথে আপনার সম্পর্ক। আমি মনে করি আপনি হচ্ছেন সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করে আমি ও আমার পরিবারকে এই আতংকজনক অবস্থা থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।”
রাসেল শাহরিয়ারও তার পরিবারের জন্য সহায়তা চেয়ে এই এমপিকে লিখেছিলেন।
রাসেল শাহরিয়ার: “তার আন্টি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার খুব ভাল একটি প্রভাব আছে। আমি মনে করি এটা জাস্ট তার জন্য ‘আপনি কি তাকে ছেড়ে দিতে পারেন?’ এমনি একটি ফোনকলের ব্যাপার মাত্র। আপনি জানেন এভাবে একজন মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারে, একটা পরিবার মুক্তি পেতে পারে।”
আমরা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গুম হওয়া কিছু মানুষের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছি যে তাদের সবার সাথে যুক্তরাজ্যের শক্ত সম্পর্ক রয়েছে। তিনি সংসদীয় নীতির উপর জোর দেন অর্থাৎ তিনি এ বিষয়ে জড়াতে পারেন না এবং তিনি আমাদের জানান তার আন্টির উপর তার কোন প্রভাব নেই। আমরা বিশ্বাস করি তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয় এই প্রথমবারের মত এই বিষয়ে রাসেল শাহরিয়ার ও সালমান আযমীকে লিখেছেন এবং বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিকে সরাসরি কটাক্ষ করে কথা বলেছেন।
রাসেল শাহরিয়ারের চিঠির জবাবে টিউলিপ লিখেন-
“আমি বিচারবহির্ভূত সকল আটক এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোন স্থানে যেকোন ধরনের মানবাধিকার লংঘনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি বিষয়টা বুঝি এবং যাদের প্রিয়জন এভাবে গুমের শিকার হয়েছেন তাদের সকলের জন্য আমার সমবেদনা রয়েছে।”
কিন্তু লেবার পার্টি এবং আওয়ামীলীগের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা দেখতে পাই সম্প্রতি লেবার পার্টির অনেক এমপি এমনকি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এমিলি থর্নবেরীকেও টিউলিপের সাথে একযোগে পার্লামেন্টে আওয়ামীলীগকে তাদের লেবার পার্টির ভাতৃসংগঠন বলে দাবি করতে।
লেবার পার্টি এটাকে একটা ভুল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে যে আওয়ামী লীগ লেবার পার্টির ভাতৃসংগঠন নয়। এমপিরা এটাকে আসলে ভুলভাবে নিয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের মত তারাও দেশটিতে মানবাধিকার অবস্থার অবনতি, গুম, হত্যা, নির্যাতন, হুমকি, নির্বিচারে আটক প্রভৃতি বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রত্যেকটি বিষয়ের দিন দিন অবনতি ঘটছে, উন্নতি নয়।