ইবনে ইসহাক
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনে শ্রীলঙ্কায় মসজিদ ও মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর একের পর এক হামলার পর দেশটিতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। মধ্যাঞ্চলীয় ক্যান্ডি শহরের কিছু কিছু এলাকায় আবার কারফিউ জারি করা হয়েছে যেখানে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সিনহালারা মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করছিলো।
সোমবার সেখানে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিলে কারফিউ জারি করা হয়। এরপর কিছু সময়ের জন্যে কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২৪ বছর বয়সী এক মুসলিম তরুণের মৃতদেহ পাওয়ার যাওয়ার সাথে সাথেই সেখানে আবার সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, “চারটি মসজিদ, ৩৭টি বাড়িঘর, ৪৬টি দোকান এবং ৩৫টি গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।”
এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে মূলত ভূমিকা রাখছে বিবিএস নামে একটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠন। বিবিএস এর পূর্নরূপ বদু বালা সেনা। এর কার্যক্রম অনেকটা ভারতের শিবসেনা বা আরএসএস এর মত। বিগত কয়েক বছর যাবত শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ চরমপন্থিরা বেশ অদ্ভুত দাবি করে আসছিলো। তাদের দাবি, রেস্তোরাগুলোতে খাবারের সাথে জন্মনিরোধক ট্যাবলেট মেশানো হচ্ছে। এর ফলে সিংহলা নারী ও পুরুষেরা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারাচ্ছে। মুসলিমরা দ্বীপে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এ কাজ করছে বলে তারা দাবি করে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখে জন্ম নিরোধক বড়ি খেয়ে কেউ বন্ধ্যা হয়ে যাবে, এমন অদ্ভুত দাবি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। পরিকল্পিতভাবেই ২০১২ সাল থেকে নানান তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করেছে বিবিএস।
শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লাখ। যার ৭০ শতাংশ হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। মোট জনগোষ্ঠীর ১৩ শতাংশ হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যার অধিকাংশই তামিল। আর ৯ শতাংশ মুসলমান। বছর কতেক যাবত সেদেশে মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার মুসলিমরা বরাবরই শান্তিপ্রিয় হসেবে পরিচিত। তামিলদের গেরিলাদের সাথে শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সময়েও মুসলিমদের সহিষ্ণু অবস্থাই লক্ষ্য করা গেছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিঙ্গের জন্য ভয়াবহ রূপ নিতে যাওয়া মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা দমনই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
শ্রীলংকায় মুসলিমদের পশু জবাই করার রীতিও এখন বিভেদের ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সেখানে হালাল খাবারের ধারণাই বেআইনি ঘোষণার দাবি উঠেছে। বদু বালা সেনার নেতৃত্বে ‘বৌদ্ধ ব্রিগেড’ সেই দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে র্যাোলির আয়োজন করছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বৌদ্ধভিক্ষুরাই। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিচ্ছেন এবং মুসলিমদের ব্যবসাপ্তিষ্ঠান বর্জনের আহ্বানও জানাচ্ছেন।
অহিংসানীতি বৌদ্ধ শিক্ষার মূল বিষয় হলেও শ্রীলঙ্কায় অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাতে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের অসহিষ্ণুতা ক্রমেই উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে। কলম্বোর শহরতলির ছোট্ট একটি মঠ বা বৌদ্ধ মন্দির। সাদা ও বেগুনি রঙের পদ্ম ফুল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে বুদ্ধের একটি ছবি। দেয়ালে সারি সারি বুদ্ধের ছবি টাঙানো। এই মন্দিরটিই কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন বিএসএস’র প্রধান কার্যালয়। সিংহলি ভাষায় সংগঠনটির নাম বদু বালা সেনা, ইংরেজিতে বুদ্ধিস্ট পাওয়ার ফোর্স।
গালাগো আত্তে নানাসেরা এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। ধর্ম নিয়ে আলোচনায় ‘শান্তিপূর্ণ নিয়মকানুনের’জন্য বৌদ্ধ ধর্মের একটি পরিচ্ছন্ন ইমেজ আছে বলে দাবি করেন। এখানকার বেশির ভাগ বৌদ্ধই জাতিগত সিংহলি। সিংহলিরা দ্বীপ দেশটির মোট জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগ। গালাগো আত্তে নানাসেরা রাগত স্বরে বলেন, এই দেশটি কেবল সিংহলিদের, সিংহলিরাই এখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জনবসতি গড়ে তুলেছে। শেতাঙ্গরাই সব সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তার মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা শ্রীলঙ্কাকে ধ্বংস করেছিল এবং এখানকার বর্তমান সাংস্কৃতিক সমস্যাও বহিরাগতদের সৃষ্ট। বহিরাগত বলতে তিনি তামিল ও মুসলমানদের বুঝিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘুরা চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে ভারত থেকে এলেও মুসলমানেরাও সিংহলি, তাদের শেকড়ও সিহংলিদের মতোই কয়েক শ’বছরের। গালাগো আত্তে নানাসেরা বলেন, আমরা দেশটিকে সিংহলিদের দেশে পরিণত করতে চাই। তা না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে। বৌদ্ধ ধর্মের এই চরম অসহিষ্ণু মনোভাব শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর বৌদ্ধ পুনর্জাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আনাগারিকা ধর্মপালা অসিংহলিদের প্রতি আরো বেশি বিদ্বেষপূর্ণ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, আর্য সিংহলিরা এই স্বর্গীয় দ্বীপ তৈরি করেছে, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকরা যা ধ্বংস করেছিল। মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি বলতেন, এই মাটির সন্তানদের নিঃশেষ করে দিয়ে তারা বিস্তার লাভ করেছে।
তামিল জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলা সহিংস বিদ্রোহী গ্রুপ তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের ফলে বৌদ্ধ কট্টরপন্থী ধারণা ফের জাগ্রত হয়। এই লড়াইকে সিংহলি ও বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতিরোধের লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করে ২০০৪ সালে নয়জন ভিক্ষু জাতীয়তাবাদী দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় এটিই ছিল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের মূল দল, পরে গালাগো আত্তে নানাসেরা সেটি ভেঙে বর্তমান দল বদু বালা সেনা (বিবিএস) গঠন করেন। একই ধরনের আদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এটি বর্তমানে এ ধারার মূল সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১২ সাল থেকে বিবিএস অন্যান্য সমজাতীয় সংগঠনের মতো সরাসরি হামলা-সহিংসতায় লিপ্ত হয়। তারা মুসলমানদের কসাইখানায় হামলা চালায়। তারা অভিযোগ করে যে, মুসলমানেরা পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করছে। এর সদস্যরা আরেকবার মুসলমানদের পক্ষে পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করার মিথ্যা অভিযোগে একটি আইন কলেজের সামনে বিক্ষোভ করে। যুদ্ধে তামিলরা পরাজিত হওয়ার পর মুসলমানেরা এখন এই বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। একই সাথে খ্রিষ্ট ধর্মীয় পাদ্রিরাও, তাদের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা ও ধূর্ততার সাহায্যে বৌদ্ধদের খ্রিষ্টান বানানোর অভিযোগ করা হচ্ছে।
অনেক উদার বৌদ্ধরাও কট্টর বৌদ্ধদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। ২০১৪ সালে রেভ ভিজ্জিথা নামে এক বৌদ্ধ ব্যক্তিকে অপহরণ করার পর অজ্ঞান করে খতনা করে দেয়া হয়। ওই ব্যক্তি মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে সহযেগিতার সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করেন বলে কট্টরপন্থী বৌদ্ধরা এই কাজ করেছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এর সাথে জড়িত বলে তিনি মনে করেন।
২০১৫ সালে ভিজ্জিথা মুসলমান সম্প্রদাযের অভিযোগগুলো তুলে ধরার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। বিবিএস সেই সম্মেলনে হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয়। গালাগো আত্তে নানাসেরা তাকে অপমান ও হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তুমি যদি এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের সাথে জড়িত হও, তোমাকে তুলে নিয়ে মাহাওয়েলি নদীতে ছুড়ে ফেলা হবে।’
গত সপ্তাহে আমপারে শহরেও বিবিএসের নেতৃত্বে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে হামলা চালায়। মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ দিনের জন্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যারা এধরনের সহিংসতায় উস্কানি দেবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।