২০১৭ সাল ভালো-মন্দ মিলিয়ে কাটিয়ে দিলেও নতুন বছরে গড়পড়তা হিসাবের কোনও সুযোগ নেই বিএনপির সামনে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অন্যতম লক্ষ্য স্থির করে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে দলটিকে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিএনপিকে দলীয় ও জোটগতভাবে অনেক পথ পেরোতে হবে। নতুন বছরে দলটির রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কয়েক স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যায়।
বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করে জোটগতভাবে অংশ নিতে হবে। এই নির্বাচনে কোনোভাবেই ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেওয়া হবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। নির্বাচনে মুখোমুখি হবে বিএনপি। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নতুন বছরে দলটির নেতাদের বক্তব্য-ভাষণেও আসবে নির্বাচনি আমেজ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৮ সাল হবে গণতন্ত্রের বছর। মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার বছর হবে এটি। মানুষ তার নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, চরম দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়ার বছর হবে ২০১৮ সাল।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। দেশটাকে মুক্ত করতে হবে। জনপ্রিয় দল হিসেবে বিএনপি তার দায়িত্ব পালন করবে। শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।’
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারকে বাধ্য করার পাশাপাশি কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রকে ‘কনভিন্স’ করতে হবে। বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বের করে আনাই হবে মূল লক্ষ্য।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে কিছু ভাবছেন না বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত দুই মাসে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে তিনি দলীয় নেতাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা বলতে পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপির ফরেইন উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বিএনপির আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সব ধরনের প্রচেষ্টাই চালাতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্টের সহযোগিতার কোনও বিকল্প নেই। তার মতে, ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের ওপর দুটি বিষয়ে ভারতের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একটি হচ্ছে, চীনের উচ্চাভিলাষী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পে অংশগ্রহণ ও সাবমেরিন কেনা এবং দেশের ব্যাংক সেক্টরে অনিশ্চয়তা তৈরি।
বিএনপির এই ফরেইন এক্সপার্ট বলেন, ‘দেশের ব্যাংক সেক্টরে অনেক ভারতীয় কাজ করছেন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি সুস্থির থাকা ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটিতেই আওয়ামী লীগ সরকার কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। তার ওপর ব্যাংক সেক্টরে অস্থিরতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় বিএনপির যেকোনও মূল্যে ভারতকে কনভিন্সে আনা অপরিহার্য।’
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দেখভালের দায়িত্ব থাকা দলের সংশ্লিষ্টদেরও নতুন করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে বলেও জানান এই ফরেইন এক্সপার্ট। যদিও শমসের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ায় দুবর্লতা এখনও কাটাতে পারেনি বিএনপি।
বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে ভারতকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকেই ঝুঁকতে হবে।’ যদিও ঢাকা সফরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, ইভিএম ও শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে ‘না’–এমন বিষয়গুলোতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি ভারত।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, আগামী বছরে বিএনপির কয়েকটি বিষয় মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মামলা মোকাবিলা করা, সংগঠন শক্তিশালী করে মনোনয়নের জন্য প্রার্থী বাছাই করা, বিভক্ত জোটকে এক করা, যুক্তফ্রন্ট ও বৃহৎ বাম জোটকে (সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চা) নিজেদের সমর্থনে রাখা, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কয়েকটি দলের কার্যকরী জোট করা এবং সে জোটকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৮ সাল হবে গণতন্ত্রের বিজয়ের বছর। আগামী নির্বাচন নিয়ে কারও ভিন্ন কোনও পরিকল্পনা থাকলে তা বুমেরাং হবে। বিএনপি নির্বাচনে যাবে এবং বিজয়ী হবে।’
এক্ষেত্রে বিএনপির সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলে সবাইকে এক হতে হবে। ছোট দলগুলোর বড় নেতারা তাদের জীবনকে গণতন্ত্রের জন্য উৎসর্গ করেছেন। যেহেতু ২০১৮ সাল গণতন্ত্র ফেরানোর বছর, সেহেতু নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ে তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবেই বিএনপি এগিয়ে যাবে।’
২০১৭ যেমন ছিল বিএনপি
এ বছর বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে দলীয় সঙ্ঘবদ্ধতা ধরে রাখে। খালেদা জিয়া তিন মাসের বেশি সময় ধরে লন্ডন সফরে থাকলেও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি। তবে সহায়ক সরকার ব্যবস্থার ঘোষণা আসবে– বছরব্যাপী এমন কথা গণমাধ্যমে ও দলীয়ভাবে প্রচার করা হলেও শেষদিকে এসে এটি আর উচ্চারণই করেননি বিএনপি নেতারা।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবসে’ বিএনপি কালো পতাকা মিছিল করতে পারেনি। প্রতিবাদে পরদিন সারাদেশে বিক্ষোভ ডাকে দলটি। ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে আপত্তি জানায় তারা। যদিও মার্চে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হন দলটির মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু।
১৯ এপ্রিল সংগঠনের ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করে কমিটি দেওয়া হয়। ১০ মে রাজধানীর একটি হোটেলে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। ২০১৬ সালের মার্চে দলের জাতীয় কাউন্সিলে ‘ভিশনের’ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। ওই ভিশনের ওপর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় দেশে।
২০ মে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। যদিও পরে অভিযানকে পুলিশ ‘প্রাপ্তিশূন্য’ বলে দাবি করে। ১৫ জুলাই খালেদা জিয়া যান লন্ডন। ফিরে আসেন ১৮ অক্টোবর। তার ফিরে আসার দিন বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত লাখো নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতি ব্যাপক সাড়া ফেলে বিএনপিতে। ২২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ২৮ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার যান বিএনপির চেয়ারপারসন। ফিরে আসেন তিন দিন পর। ওই সফরে ফেনী ও চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে তার গাড়িবহরে হামলা হয়।
কক্সবাজার সফরে নেতাকর্মীদের বিপুল সাড়া পেয়ে খালেদা জিয়া ৭ নভেম্বর ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে ১২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশে যোগ দেন। এই সমাবেশেও অংশ নেয় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।
যদিও ২০ দলীয় জোটের দুটি শরিক দলে ভাঙন ধরায় অস্বস্তিতে পড়ে বিএনপি। জোটের প্রতিষ্ঠাতা শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও লেবার পার্টি ভেঙে যায়। এছাড়া, এ বছর কয়েক জন সিনিয়র নেতাকে হারিয়েছে বিএনপি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন