অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতাবস্থা নেই। সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। দেশে কোন কার্যকর বিরোধীদল নেই। যারা সাংবিধানিকভাবে বিরোধী দল তারা নিজেরাও জানে না তারা বিরোধী দল, না সরকারি দল! দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে দলীয় আচরণ করছে। প্রকৃত বিরোধীদলও যথাযথ আচরণ না করে বিদেশী শক্তির প্রতি নির্ভরতা দেখাচ্ছে। ভিন্ন রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারতকে নিকট বন্ধু প্রমাণে সব পক্ষই যথেষ্ট চেষ্টা সাধনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক জোট বা পক্ষ যতটা না নিজ দেশের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ তার চাইতে বেশি নির্ভর বিদেশী কূটনৈতিকদের উপর। এর মূল কারণ বাংলাদেশে কার্যকর নির্বাচন হচ্ছে না বহুদিন। নির্বাচন হচ্ছে না বিধায় নির্ভরতা জনগণ না হয়ে “অন্য কিছু”।
গত নির্বাচন তথা দশম জাতীয় নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। এটা একটা নির্বাচন হয়েছে কিন্তু নির্বাচন যে উদ্দেশ্যে সে মূল উদ্দেশ্যেই ব্যাহত হয়েছে। ধরা যাক একজন রোগী পায়ে ভয়ানক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। ডাক্তাররা বহু চেষ্টা সাধনা করে সেই ভাঙ্গা পা মেরামত করলেন কিন্তু রোগী মারা গেল। দশম জাতীয় নির্বাচনের পরিস্থিতিও তাই। এককথায় বলতে গেলে “অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড”। নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের দেহে যে অপারেশন হলো, তা আইনত ঠিক থাকলেও গণতন্ত্র নামক রোগীর জীবন বিপন্নই হলো। বিএনপির বর্জনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় খালি মাঠে গোল দেয়ার সুবাদে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে। ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে এ নির্বাচন করা হলো। এর মাধ্যমে আসলেই কি সংবিধান সমুন্নত থেকেছে? নাকি সংকট কেবল বাড়িয়েছে?
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে, অবশ্যই আমাদের সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এমন নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয় তবে যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র কায়েম হয় না। এটি হতে হবে মানসম্মত ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য। আর মানসম্পন্ন নির্বাচন মানেই, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ভাষায় ‘প্রত্যক্ষ’, অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সঠিক নির্বাচন। অর্থাৎ আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয়, বরং সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।দুর্ভাগ্যবশত, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোটার নির্বাচনের দিনের আগেই তাঁদের ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ১৫৩ প্রার্থী জনগণের ভোট ছাড়াই ‘জনপ্রতিনিধি’নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭টি আসনে মাত্র ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমনকি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের একপেশে নির্বাচনেও প্রার্থী সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
মূলকথা আমাদের সাংবিধানিক চেতনা তো কেবল নির্বাচন করা নয়, একটা মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যা মোটেই অর্জিত হয়েছে বলে বলা যায় না। তাই, তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই নির্বাচনকে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন না বলে, মুখরক্ষার নির্বাচন বলাই শ্রেয়।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই বর্তমান নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এ কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই সম্ভব। এমন নির্বাচন অনুষ্ঠান আমাদের দরকার যাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়। নির্বাচনে জনগণের মতামত প্রতিফলিত না হলে শুধুমাত্র সংবিধানের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা হবে আরেকটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট তো দূর হবেই না বরং ঘনীভূতহবে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের নিমিত্তে প্রয়োজন মনে করলে সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়টিও সামনে আসতে পারে। আমরা মনে করি জনগণের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার দারুণভাবে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে শিষ্টাচার থাকা আবশ্যক। যদি সবার মধ্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার থাকতো, শঠতা, প্রতারণা, লোভ না থাকতো তবে হয়তো আমাদের এমন রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে পড়তে হত না। তবে সর্বোপরি দায়িত্ব হলো নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশইন পারে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট দূর করতে। তাই আগামীতে কাঙ্ক্ষিত মানের নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। তবে এর পূর্বশর্ত হলো- সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকাও ইতিবাচক হতে হবে। নাগরিক সমাজের ভূমিকা থাকতে হবে। যেহেতু অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে নির্ভরযোগ্য মনে করে তাই আমরাওমনে করি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হতে পারে। তবে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখটাই উচিত। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকেই। সরকারকে বিরোধীদলের উপর নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
আরেকটি জরুরি বিষয় হলো কোনো রাজনৈতিক দল যেন সহিংসতায় না জড়ায়। নির্বাচন কমিশনকে সে বিষয়টি দেখতে হবে। নির্বাচনে সহিংসতা কাম্য নয়। নৈরাজ্য ও গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলবে, এটা হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীযাতে কারো দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। গত ৫ বছরে দেশে ঐকমত্যের কোনো নির্বাচন করা যায়নি। কার অধীনে নির্বাচন হবে সেটা এখনও ঠিক করা যায় নি। জাতীয় সংসদ দুর্বল হয়ে পড়েছে। দুঃখজনক হলো আমরা সবাই এক জায়গায় বসতে পারছি না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করা দরকার। আলোচনায় অনেক সমস্যা/ সংকট সহজ হয়ে যায়।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা আবশ্যক। বাংলাদেশের সংকট কাটাতে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। আর দৃঢ়ভাবে আশাবাদী থাকতে চাই নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশন আমাদের একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হবে।
Discussion about this post