শাহদীন মালিক
সাদামাটাভাবে বুঝি, অপরাধীরা সাধারণত দুটি ভুল ধারণা থেকে অপরাধকর্মে জড়ান। প্রথমত, অপরাধীরা সাধারণত লোভ-লালসায় পড়ে অপরাধকর্ম করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধ করলেও ধরা পড়বেন না। আইন বা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে তাঁরা অপরাধের মাধ্যমে আয় করা টাকা বা সম্পদ ভোগ করতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, অপরাধীরা এই ধারণা থেকে অপরাধ করে থাকেন যে আইন তাঁদের ধরতে পারবে না অথবা পুলিশ বা আইন টের পেলে বা বুঝতে পারলেও ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বা এ ধরনের কারণে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন। ইদানীং এই দ্বিতীয় শ্রেণির অপরাধীদের খবরই পত্রপত্রিকায় ঘন ঘন আসছে।
মাস তিনেক হতে চলল গাজীপুরের ধর্ষিতা শিশুকন্যার অসহায় বাবা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের তলায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। কারণ, এই অসহায় বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, যাঁরা তাঁর কন্যাকে ধর্ষণ করেছে, তারা ক্ষমতার জোরে আইন ও পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা লোকের সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে, সমাজে তত বেশি পাশবিক, লোমহর্ষক ও বর্বর অপরাধের ঘটনা বাড়তে থাকবে।
দিনকাল সঠিক মনে নেই, পাঁচ-সাত বছর আগে এস এম শাহজাহান সাহেবের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন। পরে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন যে তাঁর দায়িত্ব পালনকালে দিনাজপুরের ইয়াসমিন নামের এক কিশোরী পুলিশের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে নিহত হয়েছিল। তাঁর আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ওই একটিই ঘটেছিল। পরবর্তীকালে দোষী তিনজন পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি হয়েছিল, তাঁদের একজনের ফাঁসি হয়, বাকি দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৯৫ সালের সেই ঘটনার পর দুই যুগ পার হয়েছে। পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক হয়তো একইভাবে গর্ব করতে পারেন, এখন প্রতিদিন অন্তত গড়ে একজন করে পুলিশের হাতে নিহত হন। নিঃসন্দেহে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে!
বগুড়ার এই কিশোরী ধর্ষণকারী তুফান সরকার নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় গোত্রের অপরাধী। ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে পুলিশ তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারবে না—এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে তিনি যে শুধু ধর্ষণ করেছেন তা নয়, বরং সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মা-মেয়েকে বেধড়ক পিটিয়েছেন। তিনিও নিঃসন্দেহে ভেবেছিলেন, তাঁর কিছু হবে না। অপরাধীদের এসব ঘটনায় মাঝেমধ্যে গণমাধ্যম বাদ সাধে। বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের অপরাধও একই সূত্রে গাথা। ভীষণভাবে বিত্তশালী অপরাধীরা নিশ্চিত ছিলেন, তাঁদের কিছু হবে না।
ক্ষমতা, প্রভাব ও বিত্তশালীদের এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা নতুন কিছু নয়। আইনের শাসন ও গণতন্ত্রহীন দেশগুলোতে এ ধরনের অপরাধ বহুদিন ধরে ঘটে আসছে, এখনো ঘটছে। আমাদের দেশে এই অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে নতুন। কিন্তু শিগগিরই এই শুরুর শেষ দেখতে পাচ্ছি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন দেশের যেকোনো আইনের ঊর্ধ্বে। দেশে চলছে বড় প্রকল্পের জোয়ার, ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার যখন ১০০ কোটি টাকায় করছে, তখন অপরাধীরা কোটি কোটি টাকা কামাই করতে পারছে। এমন সমাজে অপরাধ ক্রমেই সংঘবদ্ধ হতে বাধ্য। আর সেখানে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালীদের লীলাখেলা চলবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
এ ধরনের অপরাধ হলে আমরা নিন্দা করব, প্রতিবাদ জানাব। কিন্তু প্রকৃত সমাধানের একমাত্র যে পথ, অর্থাৎ গণতন্ত্র ও জবাবদিহি, সেই পথের ধারেকাছে যাওয়াটা একেবারে অসম্ভব হয়ে না গেলেও ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠছে। আর যাঁরা এসব থেকে লাভবান হচ্ছেন, তাঁরা তাঁদের লীলাভূমি আঁকড়ে রাখতে তত বেশি মরিয়া হয়ে উঠবেন।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post