দেশে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলিয়া মাদ্রাসা ও জনগণের সাহায্যে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসার পর এবার এই মাধ্যমে আরও একটি নতুন ধারা সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফাবা)। এই ধারায় আরবি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন ও ধর্মীয় শিক্ষার সহায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে উর্দু শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কারিকুলাম ও সিলেবাসের খসড়া প্রস্তুত করেছে ইফাবার গবেষণা বিভাগ।
ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচারে প্রতিষ্ঠিত সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রাথমিকভাবে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং পর্যায়ক্রমে মাস্টার্স পর্যন্ত ক্লাস শুরু করবে। ইবতেদায়ি ক্লাসগুলোর (১ম-৫ম শ্রেণি) অ্যাকাডেমিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘দারুল আরকাম’ (প্রাথমিক শিক্ষা)। পাস হওয়া এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হবে দ্রুত। আগামী ২৯ জুলাই (শনিবার) খসড়া কারিকুলাম ও সিলেবাস চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা করবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জানতে চাইলে ইফাবার মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরবি কারিকুলামকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ইতোমধ্যে কিছু প্রজেক্ট অনুমোদিত, এগুলোর কাজ শুরু হবে। বাংলা ভাষান্তরে কিছু বিকৃতি হওয়ায় আরবি কারিকুলামে দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদন হয়েছে, এটি বাস্তবায়ন করব। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অনার্স-মাস্টার্স পর্যন্ত প্রক্রিয়াধীন। প্রতিষ্ঠানের নাম হবে দারুল আরকাম।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশনসূত্রে জানা গেছে, নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে একটি শিক্ষামাধ্যম শুরু করার পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির। প্রাথমিকভাবে ইবতেদায়ি বা প্রাথমিক স্তরের ক্লাসগুলো মসজিদভিত্তিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ এখনও কোনও পরিষ্কার কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। বর্তমানে ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক একটি কার্যক্রম চলছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গবেষণা বিভাগের পরিচালক আবদুল হাই ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে।’ তবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অনার্স শ্রেণির জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে কোনও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা ডিজি বলতে পারবেন।’ পরে যোগাযোগ করলে ডিজি সেমিনারে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
যা আছে নতুন শিক্ষা মাধ্যমে
ইফার গবেষণা বিভাগ সিলেবাসের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে। এই খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হিফজ শিক্ষার পর (কোরআন মুখস্থ) পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ফাজিল/অনার্সের খসড়াও প্রণয়ন করা হয়েছে।
গবেষণা বিভাগের খসড়ায় দারুল আরকাম বা প্রাথমিক শিক্ষার চালু করার জন্য খসড়ায় কয়েকটি বিষয়কে প্রধান করে আলোচনা করা হয়েছে। ১. দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ২. ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রান্তিক যোগ্যতা। ৩. মাদ্রাসার কারিকুলাম। ৪. সিলেবাস ও মানবণ্টন। ৫. ইফা প্রস্তাবিত হিফজ খানার সিলেবাস ও মানবণ্টন। এবং ৬. ইফা প্রণীত শিশু শ্রেণি থেকে বিএস অনার্স পর্যন্ত প্রস্তাবিত সিলেবাস ও মানবণ্টন।
গবেষণা বিভাগের খসড়ায় দারুল আরকাম বা প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা হয়েছে। ২৩ ধারা সংবলিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অংশে বলা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর আলোকে পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রকৃত নায়েবে রাসুল (সা.) তৈরির লক্ষ্যে শিশুর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মানস গঠন এবং তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা, দেশাত্মবোধ, সামাজিকতা, সৃজনশীলতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগ্রত করে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আদর্শ জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। গাণিতিক ধারণা ও দক্ষতা অর্জন করা। বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষায় মৌলিক কিতাবাদি অনুধাবনের সুবিধার্থে উর্দু ও ফার্সি ভাষা আয়ত্ত করা। দেশের আইন কানুন ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বাধ্যবাধকতা বজায় রেখে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তায় উৎসাহিত হওয়া এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুশীলন করা।
৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি কোরআন হাদিসের ভাষা—আরবি বলা, পড়া, লেখা ও শোনার মাধ্যমে নিজে বুঝা ও অন্যকে বোঝানোর দক্ষতা অর্জনের ভিত্তি রচনা করা। এছাড়া ১৯ নম্বর ধারায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উপমহাদেশে ইলম চর্চার সহায়ক হিসেবে উর্দু ভাষা শেখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
খসড়ায় প্রান্তিক যোগ্যতা
খসড়ায় দারুল আরকামের প্রান্তিক যোগ্যতায় ধারা দেওয়া হয়েছে ৪০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ইমানের মৌলিক ৭টি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস এবং তদানুযায়ী আমল করা, কল্পনা, কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধি বিকাশে আগ্রহী হওয়া। আরবি কথোপকথনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা।
সিলেবাস ও মানবণ্টন
খসড়া অনুযায়ী, শিশুশ্রেণিতে কিরাআতুল কোরআন, দ্বীনিয়াত, আল লুগাতুল আরাবিয়া, আল হাদীসুন নাবাবি, বাংলা, ইংরেজি, হস্তলিখন ও গণিত রয়েছে। এই শ্রেণিতে ৫ পিরিয়ডে ৪০০ নম্বরে মানবণ্টন করা হয়েছে।
প্রথম শ্রেণিতে কিরাআতুল কোরআন, ফিকহুল ইসলামি, লুগাতুল আরাবিয়া, আল হাদিসুন নাবাবি, বাংলা, ইংরেজি, হস্তলিখন ও গণিত রয়েছে। এই শ্রেণিতে ৬ পিরিয়ডে ৫০০ নম্বরের মানবণ্টন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণি ও তৃতীয় শ্রেণিতেও একই মানবণ্টন করা হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে ৬৫০ নম্বরের মানবণ্টন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান যুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণিতে ৭ পিরিয়ডে ৭০০ নম্বরের মানবণ্টন করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৭৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বাংলা, সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি ও সাধারণ বিজ্ঞান বইগুলো ইনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত হবে।
একইভাবে সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিতে ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি এনসিটিবির বইগুলো পড়ানো হবে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে ১২০০ নম্বর হবে। দুই বছর মেয়াদি এই দু’টি ক্লাসে কোরআনের অনুবাদ, হাদিস, আরবি ভাষা শিক্ষা, ফিকহ, ইসলামের ইতিহাস ও বাংলা-ইংরেজি পড়ানো হবে।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রে ১৪০০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। এটিও দুই বছর মেয়াদি। এই দু’টি ক্লাসে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজকল্যাণ, পরিসংখ্যান ও ভূগোল বিষয়গুলো ঐচ্ছিকভাবে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
চার বছর মেয়াদি বিএ প্রথম বর্ষে কোরআন পড়ানো হবে। প্রথম সেমিস্টারে ৫ ও দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৫টি কোর্স পড়ানো হবে। এক্ষেত্রে সাবসিডিয়ারি হিসেবে বাংলা আবশ্যিকভাবে নিতে হবে শিক্ষার্থীদের।
বিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ানো হবে আরও দুই সেমিস্টার। এক্ষেত্রে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ানো হবে ৫, এরপরের সেমিস্টারে আরও ৫টি কোর্স। এই বছরে ইংরেজি নিতে হবে আবশ্যিকভাবে।
তৃতীয় বর্ষের পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে পড়ানো হবে ১০টি কোর্স। তৃতীয় বর্ষে সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে তাসাউফ, আরবি সাহিত্য বা আরবি ভাষার ওপর একটি কোর্স নিতে হবে।
চতুর্থ বর্ষেও দুটি সেমিস্টার থাকবে। কোর্স বরাবরের মতো ১০টি। এই বছরে হাদিস, উসুলুল হাদিস, বা ইসলামি ফিকহের একটি কোর্স নিতে হবে। অনার্সের প্রতি বছরই ৮০০ নম্বরের পরীক্ষা হবে।
নতুন ধারা প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের অভিমত
ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে দেশে আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা থাকার পরও একটি নতুন ধারার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (ইউজিসি) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউকে বলেন, ‘মাদ্রাসা তো আছেই। এক্ষেত্রে আরও একটি ধারার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’
নতুন ধারা নিয়ে এখনও গভর্নিং বডিতে কোনও আলোচনা হয়নি বলে জানান ইউজিসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমি যতগুলো সভায় গিয়েছি, কোনও সভায় নতুন ধারা খোলার বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। নতুন ধারা না করে আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসায় যেন সমন্বয় হয়, সে চেষ্টা করা যেতে পারে।’
এই প্রসঙ্গে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা তো আছেই। যারা সরকারিতে পড়তে চায়, তাদের জন্য আলিয়া মাদ্রাসাও আছে। তাহলে অন্য ধারা কেন? ’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post