চাহিদামতো টাকা না পাওয়ায় দুই চোখ তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খুলনার খালিশপুর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। গত ১৮ জুলাই রাতে এ ঘটনা ঘটে। ভোক্তভোগী শাহজালালের দাবি, তাকে শ্বশুর বাড়ির সামনে থেকে আটক করে থানায় নিয়ে টাকা চায় পুলিশ। টাকা দিতে না পারায় খুলনার বিশ্বরোড এলাকায় নিয়ে হাত-পা ও মুখ বেঁধে তার দুই চোখ তুলে ফেলা হয়। শাহজালাল বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আটক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তবে পুলিশের দাবি, খুলনার খালিশপুরের গোয়ালখালি রেললাইনের পাশে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েন শাহজালাল। এরপর জনগণ তার চোখ তোলে নিয়েছে। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ছিনতাইয়ের শিকার এক নারী বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের ৩০১ নাম্বার ওয়ার্ডে কথা হয় শাহজালালের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমি সন্ধ্যার পরপর শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হয়েছি, আমার ১০ মাসের মেয়ের জন্য দুধ কিনতে। যাচ্ছিলাম দৌলতপুর। বাসা থেকে একটু সামনে যেতেই তিনটি মোটরসাইকেলে করে আসা পুলিশ হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আমাকে নিয়ে যায়। তারা বলে তোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। এরপর থানায় নিয়ে আমাকে অনেক মারছে। হাত-পা ফেটে গেছে। তখন পুলিশ বলে, ‘এক লাখ টাকা দে, তোকে ছেড়ে দেবো।’ আমি বলি, আমি এত টাকা কোথায় পাবো। আমার কাছে এত টাকা নাই। এরপর পুলিশ গাড়িতে তুলে আমাকে আড়াইশ’ বেড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবে বলে থানা থেকে বাইরে নিয়ে যায়।’’
এরপর হাসপাতালে না নিয়ে পুলিশ তাকে নিয়ে যায় খুলনা বিশ্বরোডে। সেখানে হাত-পা ও মুখ বেঁধে দুই চোখ তুলে ফেলে বলে দাবি করেন শাহজালাল।
তিনি বলেন, ‘‘মারধর শেষে আমাকে নিয়ে পুলিশ বাইরে যায়। তখন আমার স্ত্রী থানার বাইরে ছিল। আমার স্ত্রী যখন তাদের কাছে জানতে চায়, ‘ওনাকে কোথায় নিচ্ছেন?’ তখন পুলিশ বলছে, ‘হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসার জন্য।’ কিন্তু তারা আমাকের নিয়ে যায় বিশ্বরোড। গাড়ি থেকে নামিয়ে আমার হাত-পা ও মুখ বেঁধে চোখ তুলে ফেলে।’’
পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় দুটি মোটরসাইকেলেও পুলিশ ছিল। তবে গাড়ির ড্রাইভার বাদে আর কারও গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল না বলে জানান শাহজালাল।
ভুক্তভোগী শাহজালালের স্ত্রী রাহেলা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ি পিরোজপুরের কাউখালী থানার সুবিদপুরে। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে আমি বাবার বাড়ি খালিশপুরে আসি। আমার স্বামী আসে আরও দুই-তিন পর। ওইদিন সন্ধ্যার পর আমার মেয়ের জন্য দুধ কিনতে উনি (শাহজালাল) বাইরে বের হয়েছিলেন। বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর পাড়ার কয়েকটা ছেলে আইসা জানায়, তোমার স্বামীরে রাসেল আর মামুন দারোগা ধইরা নিছে। তাড়াতাড়ি থানায় যাও। এরপর আমি থানায় যাই। থানায় গিয়া প্রথমে উনারে দেখতে পাই নাই। পরে একজন পুলিশরে একশ টাকা দিলে দেখতে দেয়। তখন তার চোখে কোনও সমস্যা দেখি নাই। তখন আমাকে উনি বলেছেন, পুলিশ নাকি ওনাকে অনেক মারধর করেছে। দেখা করার পর থানা থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়। একজন পুলিশ তখন বলে, এক লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেবে।’
রাতে সাড়ে ১১টার দিকে শাহজালালকে থানা থেকে গাড়িতে করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান, রাহেলা। তিনি বলেন, ‘ আমাকে বের করে দেওয়ার পর আমি থানার বাইরেই ছিলাম। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ ওনাকে নিয়ে বাইরে বের হয়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমি জানতে চাই। তখন একজন পুলিশ বলে, তাকে চিকিৎসার জন্য আড়াইশ’ বেড হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ওনারা চলে যাওয়ার পরও আমি থানার সামনেই ছিলাম। সারারাত আর ওনাকে থানায় নিয়ে আসেনি।’
পরদিন সকালে খালিশপুর থানার একজন পুলিশ রাহেলাকে বলেন, আড়াইশ বেড হাসপাতালে খোঁজ নিতে। এরপর হাসপাতালের গিয়ে তিন তলার মেঝেতে শাহজালালকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান।
কান্না জড়িত কণ্ঠে রাহেলা বলেন, ‘আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি, মরা লাশের মতো উনি ফ্লোরে পরে আছেন। দুই চোখসহ সারা গায়ে রক্ত। আশেপাশের মানুষের কাছে শুনলাম, তার নাকি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ টাকা না পাইয়া আমার স্বামীর দুই চোখ তুলে ফেলছে। সারা জীবনের লাইগা অন্ধ বানাই দিছে। আমি এর বিচার চাই।’
একই কথা বলেন শাহজালালের বাবা জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি পিরোজপুরের কাউখালী। আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে শাহজালাল সবার বড়। টুকটাক ব্যবসা করতো। যখন যেটা পারতো। এ ঘটনার আগে সে রাস্তায় চার্জ লাইট বিক্রি করতো। পুলিশ আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। টাকা না পেয়ে তারা চোখ তুলে নিলো।’
শাহজালাল বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. ফরিদুল হাসানের তত্ত্বাবধানে। ডা. ফরিদুল হাসান বলেন, ‘আঘাত খুবই গুরুতর। তার চিকিৎসা চলছে। এখনও কোনও অপারেশন করা হয়নি। চোখ পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে চোখ ভালো করা সম্ভব হবে কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না।’
এদিকে টাকা না পেয়ে চোখ তুলে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনার খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম খান বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়লে জনগণ তাকে মেরেছে। আমরা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। পুলিশ দশ মিনিট পরে গেলে হয়তো তার লাশ পাওয়া যেত।’
তিনি বলেন, ‘গোয়ালখালী বাসস্ট্যান্ডে সুমা আক্তার নামে এক নারী তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাচ্ছিলেন। রাস্তার সুমার ব্যাগ ছিনতাই করে নেওয়ার সময় শাহজালালকে ধরে মারধর করে জনগণ। আমরা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করি। পরবর্তীতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সুমা বাদী হয়ে দ্রুত বিচার আইনে ৩ ও ৪ ধারায় মামলা করেন।’
শাহজালালের বিরুদ্ধে খুলনার বিভিন্ন থানায় ছয় থেকে সাতটি মামলা রয়েছে বলেও দাবি করেন খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post