অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গত সপ্তাহে একদলীয় সংসদে পাস হওয়া বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে সংসদের হাতে আর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকছে না। এখন সরকার ইচ্ছে করলেও হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারবে না।
এ রায়ে দেশের আইন বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু চরম নাখোশ হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা। শুধু নাখোশ নয়, সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা প্রচ- ক্ষুব্ধও হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপিরা তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন রোববার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে। আপিল বিভাগের এই রায়কে তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেও আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি তুলেন তারা।
সংসদ অধিবেশনে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা শুধু ক্ষোভই প্রকাশ করেন নি, রায় নিজেদের পক্ষে না যাওয়ায় অশালীন ভাষায় বিচারপতিদের গালিগালাজও করেছেন। আইনের দৃষ্টিতে যা শুধু আদালত অবমাননাই নয়, দণ্ডণীয় অপরাধও বটে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, বিচারপতি সিনহা ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধকতা বা বাধা হিসেবে পরিচিত অপরাধ করেছেন, যা দণ্ডবিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ গোরস্থান পাঠিয়েছে, সে পাকিস্তান হলো প্রধান বিচারপতির আদর্শ। জনগণ কৈফিয়ত নেবেই নেবে। কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে না।
আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘অবৈধ’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আপনি রায় দিয়েছেন, রায় নিয়ে বসে থাকেন। আপনারা নিজেরা রিভিউ করেন যে আমাদের ভুল হয়েছে। আপনারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, আপনাদেরই করতে হবে। আমরা করব না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদার। কিন্তু শত্রুকে শত্রু মনে করতে হবে। মিত্র ভাবা যাবে না। তাঁদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি, যেই হোন না কেন, অভিশংসন (ইমপিচ) করতে হবে। রায় দিয়ে ইমপিচমেন্ট ঠেকানো যাবে না।
আদালতের রায় নিজেদের পক্ষে না গেলে বিচারকদের সমালোচনা বা অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এটাই নতুন নয়। এর আগেও তারা রায় নিজেদের পক্ষে না যাওয়ায় বিচাপতিদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিলও করেছে। ২০০০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলা একজন বিচারপতি দ্বিধাবিভক্ত রায় দেয়ায় তৎকালীন স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী নাছিমের নেতৃত্বে বিচারপতির বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করেছিল আওয়ামী লীগ। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে মিছিল কিংবা গালিগালাজ করলেও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে এটা আদালত অবমাননা বা অপরাধ নয়। কিন্তু, অন্য কেউ যদি আদালতের রায় নিয়ে কথা বলে তাহলে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৃষ্টিতে সেটা মহা অপরাধ।
দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কথিত যুদ্ধাপরাধের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে জামায়াতে ইসলামীর ৫ জন শীর্ষ নেতাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়েছে। ভুয়া সাক্ষী, অসত্য তথ্য-উপাত্য ও আসামি পক্ষের সাক্ষীদের গুম করে সরকার এ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যে কারণে বিচারের স্ব”ছতা নিয়ে দেশি-বিদেশি আইন বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও প্রশ্ন তুলেছেন।
কিন্তু, সরকারের গৃহপালিত ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এটাকে আদালত অবমাননা বলে আখ্যা দিতো। আদালতও জামায়াতের একাধিক নেতারা বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছে।
ঠিক একই ভাবে আদালত থেকে সরকারের ফরমায়েশি রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে বিএনপির অনেক নেতাকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। আদালত নিয়ে অন্যরা কিছু বললেই এটাকে আদালত অবমাননা বা দণ্ডণীয় অপরাধ বলে আওয়ামী লীগ নেতারা হৈচৈ শুরু করে দেন। কিন্তু, নিজেরা যখন বিচারপতিদেরকে অশালীন ভাষায় গালি দেন তখন সেটা অপরাধ নয়।
Discussion about this post