ভারতে দশ বছরের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনায় আদালতের রায় দু’রকম হলো কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
দুটি মামলায় আদালতের রায় এসেছে এ সপ্তাহেই। প্রথমটিতে মুম্বাই হাইকোর্ট গুজরাট দাঙ্গার সময়ে ধর্ষিতা হওয়া বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও পরদিনই দিল্লির চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ধর্ষণকারীদের ফাঁসির সাজা বহাল রেখেছে।
দুটো ঘটনায় কেন দুরকম সাজা, তা নিয়ে ভারতে অনেকেই ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলছেন – আর বিলকিস বানো এ ব্যাপারে নিজে তার বক্তব্য নিয়ে সোমবার হাজির হচ্ছেন দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের সামনে।
এদিকে ভারতে আইনের বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবে তা নিয়ে আদালতের ব্যাখ্যাতেই বেশ অস্পষ্টতা আছে।
২০০২ সালে গুজরাতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মাত্র উনিশ বছর বয়সী বিলকিস বানো ছিল পাঁচ মাসের গর্ভবতী।
কোলের মেয়ে সালেহা আর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ছোট একটা ট্রাকে চেপে তারা যখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন তাদের পথ আটকে বিলকিসকে গণধর্ষণ করে একদল লোক। হত্যা করা হয় তার মেয়ে, মা ও পরিবারের আরও দশ-বারোজনকে।
সেই অপরাধীদের মধ্যে মূল তিনজনের মৃত্যুদন্ড চেয়েছিল সিবিআই, তবে বৃহস্পতিবার মুম্বাই হাইকোর্ট তা খারিজ করে দিয়ে অভিযুক্ত ১১জনকেই যাবজ্জীবন দিয়েছে।
কিন্তু ঠিক তার পরদিন দিল্লির চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার, নির্ভয়া নামে পরিচিত মেয়েটির নির্যাতনকারীরা সবাই সুপ্রিম কোর্টে ফাঁসির সাজা পাওয়ার পর দুটো রায়ের মধ্যে চলে আসছে অবধারিত তুলনা।
অ্যাক্টিভিস্ট ফারাহ নকভি, যিনি বিলকিস বানোকে সোমবার দিল্লির প্রেস ক্লাবে মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসছেন, তিনি বিবিসিকে এদিন বলছিলেন দুটো ঘটনাই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ভয়াবহতম দৃষ্টান্ত – আর দুটোর মধ্যে তুলনা টানাও খুব নিষ্ঠুর ও অপ্রয়োজনীয়।
“তবে আমি এটুকু বলতে পারি, নির্ভয়ার বাবা-মা যদি তার মেয়ের ধর্ষণকারীদের ফাঁসিতে সান্ত্বনা পেতে পারেন তাহলে বিলকিস বানোরও অধিকার আছে তার নির্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ সাজা চাইবার। আর তা সে চাইবেও” – বলছেন মিস নকভি।
কেন একটা ঘটনায় ফাঁসি, আর অন্যটায় যাবজ্জীবন – এ প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাটও। হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি আরও তির্যক ভাষায় বলেছেন, মুসলিম বলেই কি বিলকিস বানো সঠিক বিচার পাচ্ছেন না?
মি. ওয়াইসির বক্তব্য, “হাইকোর্টকে সম্মান করলেও আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি ধর্ষণের ঘটনা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ঘটা ধর্ষণের মধ্যে কেন ফারাক করা হচ্ছে? এর আগে ইয়াকুব মেমনকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল মুম্বই বিস্ফোরণের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের প্রমাণ না-পাওয়া সত্ত্বেও।”
“বিলকিসকে গর্ভবতী অবস্থায় যারা ধর্ষণ করেছিল, তার মা-বোন-মেয়েকে চোখের সামনে যারা হত্যা করেছিল – আমি তো মনে করি তাদেরও ফাঁসির সাজা হওয়া উচিত।”
বিলকিস বানো গণধর্ষণের সময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি – তার সরকার সঠিকভাবে এই ঘটনার তদন্ত করেনি ও দোষীদের আড়াল করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন মি. ওয়াইসি।
ভারতের আইন বলে ‘বিরলের মধ্যেও বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রেই কেবল মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় – যদিও কোন অপরাধ সেই পর্যায়ে পড়বে সেটা আদালতের ব্যাখ্যার ওপরেই অনেকটা নির্ভর করে, বিবিসিকে বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি জাস্টিস অশোক গাঙ্গুলি।
তার কথায়, “রেয়ারেস্ট অব দ্য রেয়ার কেস কোনগুলো, সেটা বিবেচনার এক্তিয়ার জজসাহেবেরই। ১৯৮০ সালে বচ্চন সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল বিরলের মধ্যেও বিরলতম অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবে। পাশাপাশি তারা এটাও বলেছিল সেগুলো কোনটা, তা স্থির করার আগে মাথায় রাখতে হবে প্রতিটা অপরাধেই কিছু অ্যাগ্রাভেটিং ও মিটিগেটিং ফ্যাক্টর থাকে – অর্থাৎ কিছু ঘটনা বা তথ্য সেই অপরাধের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়, কিছু আবার কমিয়ে দেয়।”
বিলকিস বানো বা নির্ভয়ার ঘটনা, কোনটা বেশি নৃশংস তাই সেটাই শুধু বিচার্য নয় – দুটো ক্ষেত্রে অপরাধীদের প্রোফাইলও আদালতকে বিবেচনায় নিতে হয়।
জাস্টিস গাঙ্গুলি আরও বলছিলেন, “মৃত্যুদন্ডের সাজা দেওয়ার আগে অপরাধ আর অপরাধীকেও আলাদা করে দেখতে হবে। ফাঁসির সাজা দিতে হলে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে ওই অপরাধীকে শোধরানোর আর কোনও সুযোগ নেই, আর সে গোটা সমাজের জন্য একটা ভয়ঙ্কর বিপদ!”
যেহেতু নির্ভয়ার ধর্ষণকারীরা বেশ কম বয়সী বা তাদের প্রায় সবারই এটা ছিল প্রথম অপরাধ, তাই সেই যুক্তিতে মৃত্যুদন্ড থেকে তাদের রেহাই পাওয়া উচিত ছিল বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।
কিন্তু সেই একই দেশে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীরা কীভাবে ফাঁসি এড়াতে পারছে – সেটাও যথারীতি কম লোককে বিস্মিত করেনি!
বিবিসি বাংলা অবলম্বনে
Discussion about this post