এনালাইসিস বিডি ডেস্ক
ওয়ানডে এবং টেষ্ট সিরিজ দুটোতেই ট্রপিকে একান্ত নিজেদের করে নিতে পারেনি বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলংকা। টি-টোয়েন্টি সিরিজেও কি এমনটা হতে পারে? হতে পারে, তবে সে জন্য বাংলাদেশকে আজ শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি জিততে হবে প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে। সেটি সম্ভব কি না, কোটি টাকার প্রশ্ন।
কিন্তু সব ছাপিয়ে কলম্বোর রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে কিংবা হোটেল তাজ সমুদ্রে দীর্ঘ এক শরীরের ছায়া উঠছে বড় হয়ে। সেটি আর কারোর নয়, বাংলাদেশের সীমিত ওভারের ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার। পরশু প্রথম টি-টোয়েন্টিতে হঠাৎ অবসর ঘোষণা করে নিজের ছায়াটিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে দিয়েছেন মাশরাফি। ম্যাচের আগে টসের সময় হঠাৎ এমন অবসরের ঘোষণায় বাংলাদেশিদের মত শ্রীলঙ্কান সাংবাদিকেরাও অবাক।
সবার আগে নিজের ফেসবুক পেজে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তাঁকে বিদায়ী অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন তাঁর সতীর্থরা।
টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফি বিন মুর্তজার অবসরের ধরনটি অনেকটা চমকপ্রদই বলতে হবে। টসের সময় এভাবে অবসরের ঘোষণা আর কবে কে দিয়েছে? তেমনি বিস্ময়কর অবসরের সময়টিও। কেন ঠিক এই সময়টাতেই?
নিজের অফিসিয়াল ফেইসবুক পাতায় মাশরাফি বলেছেন, তরুণদের সুযোগ দিতেই এই অবসর। অথচ শ্রীলঙ্কা যাওয়ার ঠিক আগে বিডিনিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলে গিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি নিয়ে তার স্বপ্নের কথা। বলেছেন, ওয়ানডের মত টি-টোয়েন্টি দলটিকেও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চান অবসরের আগে।
দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর কথা বলেও হঠাৎ কেন এই অবসর? কেন এত দ্রুত বদলে গেল তার ভাবনা? ২০০৯ সালের পর আর টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারেননি শরীরের কারণে। ওয়ানডে ক্রিকেট থেকেও আনুষ্ঠানিক অবসর নেননি এখনও। তাহলে টি-টোয়েন্টি থেকে কেন?
প্রথম আলো, বিডিনিউজসহ বিভিন্ন পত্রিকা বিসিবির বেশ কয়েকটি সূত্র ও মাশরাফির ঘনিষ্ঠজনদের বরাত দিয়ে মাশরাফির হঠাৎ অবসর ঘোষণার জন্য যেই গোপন কারনগুলোকে দাঁড় করিয়েছেন সেগুলো হলো-
“জাতীয় দলের প্রধান কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে বেশ কিছুদিন আগেই বিসিবি কর্তাদের জানিয়েছেন, মাশরাফি, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের মত বুড়োদের তিনি টি-টোয়েন্টি দলে জরুরি মনে করেন না। তরুণদের নিয়ে টি২০ দল সাজাতে চান তিনি। আপাতত কোচের ভাবনার বাস্তবায়ন শুরু মাশরাফিকে দিয়েই।”
“টি-টোয়েন্টি দলকে দাঁড় করানোর মাশরাফির স্বপ্ন ধাক্কা খায় এবার শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পরই। বিসিবির শীর্ষ কর্তারা তাকে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে বলেন। ‘ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা’ মানে যে আসলে অবসর নিয়ে ভাবা, সেটি তো আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না!”
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপন সেই কথাই স্বীকার করলেন প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন- ‘আমরা আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা ভেবে চাইছিলাম, মাশরাফি টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিক। কারণ পরবর্তী অধিনায়ককে তার দল গুছিয়ে নিতে সময় তো দিতে হবে।’
সুতরাং বলা যায়, মাশরাফি নিজ থেকে নয়, অনেকটা ক্রিকেট বোর্ড আর কোচের চাপেই অবসর ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। কোচের ‘তরুণদের দিয়ে দল গড়া’ ও বিসিবির ‘চাওয়ার’ প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন মাশরাফি তার ফেসবুক পোষ্টেও।
মাশরাফি তার ফেসবুক পোষ্টে বলেন, “আমি মনে করি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট থেকে অবসর নেয়ার জন্য এটাই আমার উপযুক্ত সময় যাতে অনেক তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটার তাদের প্রতিভা তুলে ধরতে পারে এবং বিসিবি তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। আমি বাংলাদেশ এর টি-টোয়েন্টি টিম এর নতুন অধিনায়ক কে আগাম অভিনন্দন জানাই এবং আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা সময় সামনে আসবে।”
মাশরাফির এই হঠাৎ অবসরকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা তার ভক্তকুল তথা দেশের সকল ক্রিকেটপ্রেমীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে মাতম। প্রায় সবারই সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও কোচ হাথুরুসিংহে।
কাওসার সুমন নামে একজন প্রোফাইল পিকচারে মাশরাফির ছবি দিয়ে লিখেছেন , “যে খেলা নিয়ে মানুষের এতো আবেগ, উত্তেজনা, ভালোবাসা – সেই খেলা নিয়েই খেলছে বিসিবি! যে ছেলেটা জীবনের তোয়াক্কা না করে দেশবাসীকে হাসাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, আবেগে ভাসাচ্ছে – তাকে নিয়েই খেলছে বিসিবি! কে হাতুরু, কে পাপন?”
সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তজা তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন- “একজন মাশরাফির বিকল্প পাওয়া শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। মনে রাখতে হবে, ক্রিকেটকে আজকের অবস্থানে এনেছেন ক্রিকেটাররা-মাশরাফিরা, আপনি নন। নিশ্চিত করেই বলা যায়, মাশরাফি ছাড়াও বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে। এভাবে না হলেও, মাশরাফিকে বিদায় নিতেই হতো। কিন্তু মানসিক কষ্ট বা আঘাত দিয়ে মাশরাফিকে বিদায় করার কোনও অধিকার আপনার নেই মি. পাপন। আপনাকে কেউ মনে রাখবে না, মাশরাফিকে কেউ ভুলবে না- কোনও দিন ভুলবে না।”
অনেকেই মাশরাফির ছবি প্রোফাইল পিকচারে দিচ্ছেন। কেউ কেউ সবাইকে মাশরাফির ছবি প্রোফাইলে সেট করতে আহ্বানও জানাচ্ছেন।
“মাশরাফি ভাইয়ের অবসর মানি না, মানব না!” এরকম হরেক নামে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলা হচ্ছে। কেউ কেউ ইভেন্ট খুলে মাশরাফির অবসরের প্রতিবাদে শুক্রবার বিসিবি অফিসের সামনে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে মাশরাফির আকস্মিক বিদায় মেনে নিতে পারেনি তার সতীর্থরাও। তার অবসরের ঘোষণাটি শুনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। তরুন ক্রিকেটার মোসাদ্দেক হোসেন দিলেন সেই মুহূর্তের বর্ণনা, “টিম মিটিংয়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারও মুখে কোনো কথা ছিল না। কেউ কিছুই বলতে পারছিল না। আমরা মিটিংয়ের পরে তাঁর কক্ষে যাই। সেখানে সবাই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম।”
মোসাদ্দেক বললেন, “শেষ ম্যাচটা বিদায়ী টি-টোয়েন্টি অধিনায়ককে উৎসর্গ করতে চায় খেলোয়াড়েরা, ‘এই ম্যাচে জয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলব, আমরা দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি খেলব শুধু মাশরাফি ভাইয়ের জন্য। আমরা সবাই চাইব ওই ম্যাচ জিতে তাঁকে বিদায়ী উপহার দিতে।”
সিনিয়র ক্রিকেটাররা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন প্রায় সবাই। তার পরও নিশ্চিত জেনে বিষন্ন ছিলেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই জানিয়েছেন প্রতিক্রিয়া।
টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম যেমন মাশরাফি ছাড়া বাংলাদেশ দল ভাবতেই পারছেন না।
“অসাধারণ সব কিছুই একটা সময় শেষ হয়…এটাও সম্ভবত সেটিরই একটি। ম্যাশ, আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ দল ভাবাও আমাদের প্রত্যেকের জন্য কঠিন। আপনি সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। আমি নিশ্চিত, আমার মতো দলের সবাই আপনার নেতৃত্বে খেলতে পেরে গর্বিত।”
“আমরা যখনই হতাশ ছিলাম, প্রতিবারই আমদের উজ্জীবিত করার জন্য এবং আমাদের সবার অনুপ্রেরণা হওয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমরা যতটা হতাশ, জানি টি-টোয়েন্টি জার্সিটা আপনিও মিস করবেন।”
টেস্ট সহ-অধিনায়ক তামিম ইকবাল শুধু দীর্ঘদিনের সতীর্থই নয়, মাশরাফির কাছের বন্ধুও। বাঁহাতি ওপেনার বিদায় জানানোর সঠিক ভাষাই খুঁজে পাচ্ছেন না।
“প্রসঙ্গ যখন আমাদের অধিনায়ক মাশরাফি ভাই, যত বেশিই বলি না কেন, কম মনে হবে। তার হয়ত বিশ্বরেকর্ড নেই, অন্য দেশের কিংবদন্তিদের মতো নেই ৪০০-৫০০ উইকেট, কিন্তু নিজের মতো করেই ছাপ রেখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে।”
“বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে পরিবর্তন ও মর্যাদা আমরা দেখি, সেটি সম্ভব হয়েছে তার নেতৃত্বেই। আমার মতে সেটি বিশ্বরেকর্ড বা ৪০০ উইকেটের মতোই। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটি ড্রেসিং রুমকে পরিবার হিসেবে গড়ে তোলা যায় এবং একই সঙ্গে ফলও এনে দেওয়া যায়। অনুসরণীয় একজন, আমার মতে মাশরাফি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।”
মাহমুদউল্লাহর কণ্ঠে হাহাকর যেন আপনজনকে হারানোর!
“আমরা সবাই আপনাকে মিস করব, বিশেষ করে আমি। আপনি আমার ভাই, আমার বন্ধু, যার সঙ্গে আমি সবকিছু ভাগাভাগি করতে পারি। আপনি একজন যোদ্ধা, একজন অসাধারণ নেতা, অধিনায়ক ও সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।”
“সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছে, কিন্তু আমাদের জীবনটিই এমন! আপনি আমাদের দেখিয়েছেন কিভাবে একটি দলকে পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। আপনার কাছ থেকে এত কিছু শিখেছি! আপনি অসাধারণ একজন ক্রিকেটার, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুব ভালো একজন মানুষ। ম্যাশ, আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি।”
মাশরাফি তাসকিন আহমেদকে মজা করে ডাকেন ‘হিরো’ বলে। শুধু ক্রিকেটই নয়, মাঠের বাইরেও যে কোনো সমস্যা, প্রয়োজন, পরামর্শে তাসকিনের আশ্রয় মাশরাফি। সেই মানুষটির অবসরের কথা জেনে তাৎক্ষনিক নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তাসকিন।
মাঠে নিজের পিঠে মাশরাফির হাত রাখার একটি ছবি পোষ্ট করে তাসকিন আহমেদ জানিয়েছেন তার ভালোবাসা ও আবদার।
“জানি না আর কতদিন এই হাতটা খেলার মাঠে আমার কাঁধে পাব…জাতীয় দলের অভিষেক হওয়ার আগে থেকেই আপনি আমার আইডল.. আর গত তিন বছর ধরে একজন অভিভাবকের থেকেও অনেক বেশি কিছু .. সব সমস্যার সমাধক হিসেবেও বার বার আপনাকেই জ্বালাবো ১০০% সিওর ..।”
“ভাইয়া জীবনে যাদেরকে অফুরন্ত ভালবাসি এবং যাদেরকে মানি তার মধ্যে আপনি অন্যতম ..অনেক কিছু নেওয়ার বাকি আছে আপনার কাছে থেকে.. শিখার আশার অপেক্ষায় থাকলাম …।”
অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে নিজের বিদায়ের সিদ্ধান্তের পেছনে যা-ই থাকুক, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হোক তা চান না মাশরাফি বিন মুর্তজা।
কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয় এই সময় বিতর্ক না তৈরি করে আমাদের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করা উচিত। আমাদের ক্রিকেট এগিয়ে যাক। আমার কাছে মনে হয় না এই সব নিয়ে আলোচনা করার কিছু আছে।’
অবসর ঘোষণার পর প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা জিতলে অন্যরকম তৃপ্তিই পেতেন। তবে মাশরাফি ব্যাপারটা দেখছেন খুব সাধারণভাবেই। তার ভাষায় ‘সেদিন রাতে যখন সিদ্ধান্ত নিই তখন জানতাম এমন একটা প্রশ্ন আসবে। বাংলাদেশের জন্য খেলছি। একটা ম্যাচ জিতলে সেটা বাংলাদেশই জিতবে। সেখানে মাশরাফির চেয়ে দেশ অনেক বড় ‘
এদিকে দুটি টি২০ সিরিজের শেষ ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। আজকের এই ম্যাচটি যে টাইগাররা তাদের প্রিয় বিদায়ী অধিনায়ককে উৎসর্গ করবেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে তরুন টাইগার মোসাদ্দেক তো সেদিনই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, শেষ ম্যাচ তারা খেলবে শুধুই মাশরাফি ভাইয়ের জন্য।
গত ম্যাচের ভুলগুলো আজ শোধরানোর চেষ্টা করবেন সাকিব-তামিমরা। তাঁরা যে খেলবেন অধিনায়কের জন্য! রাতের প্রেমাদাসায় বাংলাদেশকে আজ বিজয়ী দেখা যেতেই পারে।
যেখানে আলোর উচ্ছ্বাসে মাশরাফির মুখে এক টুকরো বিষণ্নতা থাকবে। তবে গর্ব ও বিজয়ের অনুভূতিটাই যেখানে ঝলমল করবে বেশি। মাশরাফির মতো একজন চ্যাম্পিয়নের বিদায়ী ম্যাচে বিজয়ই সর্বোত্তম অর্ঘ্য।
Discussion about this post