বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যত সরকার এসেছে তারা সবাই জ্বালানীতে ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২-এর জুলাই পর্যন্ত এই মাত্র ছয় মাস তারা কিছুটা সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়েছে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে। গত ৭ বছরের লাভ তারা লুট করে ফেলেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি জানিয়েছে ছয়মাসে জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
বিশ্ব বাজারে তেলের দাম নজিরবিহীন কমে আসায় ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করেই সংস্থাটি মুনাফা করেছিলো প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েক দিন আগে ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। এরপর ১৫ বছরে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক উত্থান-পতন হয়। করোনার সময় ২০২০ সালে তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে নামে। এতে অস্বাভাবিক মুনাফা করে ফুলেফেঁপে উঠে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমেনি। যদিও লোকসানের অজুহাতে বিভিন্ন সময় দেশে তেলের দাম ঠিকই বাড়ানো হয়েছে।
২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৪৬ টাকা, পেট্রোল ৭৪ টাকা ও অকটেন ৭৭ টাকা। বর্তমানে এ দাম যথাক্রমে ১০৯ টাকা, ১২৫ টাকা ও ১৩০ টাকা। অর্থাৎ ডিজেলের দাম বেড়ে প্রায় ২৩৭ শতাংশ হয়েছে। আর পেট্রোল ও অকটেন বেড়ে প্রায় ১৬৯ শতাংশে পৌঁছায়।
বিপিসির তথ্যমতে, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহ পরই (১৩ জানুয়ারি) ডিজেলের দাম ২ টাকা কমানো হয়েছিল। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৪৪ টাকা। তবে ২০১১ সালে চার দফা বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। প্রথমবার ৬ মে সব ধরনের তেলের লিটারে ২ টাকা হারে বাড়ানো হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৪৬ টাকা, পেট্রোল ৭৬ টাকা ও অকটেন ৭৯ টাকা। ১৯ সেপ্টেম্বর তা আরও ৫ টাকা হারে বাড়ে। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৫১ টাকা, পেট্রোল ৮১ টাকা ও অকটেন ৮৪ টাকা।
১১ নভেম্বর ও ৩০ ডিসেম্বর এ দাম আরও ৫ টাকা করে মোট ১০ টাকা বাড়ে। এতে ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৫৬ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা। আর ৩০ ডিসেম্বর প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৬১ টাকা, পেট্রোল ৯১ টাকা ও অকটেন ৯৬ টাকা। ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি তা আরও ৫ টাকা করে বেড়ে হয় যথাক্রমে ৬৮ টাকা, ৯৬ টাকা ও ৯৯ টাকা। যদিও ধারাবাহিক মুনাফার পরও ওই বছরগুলোয় বিপিসি লোকসানে ছিল।
এদিকে ২০১৪ সালের পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করে। একসময় দাম অনেকটা কমলে সমালোচনার মুখে ২০১৬ সালে তা মাত্র লিটারে ৩ টাকা হারে কমানো হয়েছিল। সে বছর ২৫ এপ্রিল প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা। এরপর আর্ন্তজাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমে। এতে বিপিসির মুনাফা বাড়তেই থাকে। তবে দেশের বাজারে তেলের দাম সমন্বয় করা হয়নি। বরং বিপিসির পুরোনো লোকসানের ঘাটতি সমন্বয় করা হচ্ছে বলে যুক্তি দেয়া হয়েছে সে সময়।
করোনাকালে জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে যায়। এর পরও দেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। এতে ২০২০-২১ অর্থবছর বিপিসি রেকর্ড ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ২০২১ সালে ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ৮০ টাকা। তবে পেট্রোল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিতই রাখা হয়।
যদিও ৯ মাস পরই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ওই সময় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা এবং পেট্রোল ৮৮ টাকা ও অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়। এতে ২০২২ সালের ৬ আগস্ট দেশে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১১৪ টাকা, পেট্রোল ১৩০ টাকা ও অকটেন ১৩৫ টাকা। অথচ ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিন্মমুখী ছিল।
সমালোচনার মুখে অনেকটা বাধ্য হয়েই একই মাসে ২৯ তারিখ প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা হারে কমানো হয়। এতে ২৯ আগস্ট প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা। যদিও পরে ডিজেলের দাম আবারও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল বিপিসি। তবে সরকার তা অনুমোদন করেনি। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্চ থেকে প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। এজন্য নীতিমালাও অনুমোদন করে রেখেছে সরকার। এতে ডিজেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। কারণ ডিজেলে বিপিসির কিছুটা লোকসান হয়। তবে পেট্রোল ও অকটেনে মুনাফা হওয়ায় এ দুই জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমতে পারে। যদিও পেট্রোল-অকটেনের দাম কমার সুফল পাবেন শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরাই। আর ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহন খাতসহ ভোগ্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে লম্বা সময় ধরে নিম্নমুখী থাকলেও দেশে ছয় বছর কমানো হয়নি জ্বালানি তেলের দাম। এতে সাত বছরে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে সংস্থাটি। তবে ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসানে পড়ে দেশে জ্বালানি তেলের একমাত্র আমদানিকারক ও বিপণনকারী সংস্থা বিপিসি। তবে গত বছর জুলাই থেকে আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে কমতে শুরু করায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বড় মুনাফা করেছে সংস্থাটি।
বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রথম বড় অঙ্কের মুনাফা করে সংস্থাটি। এরপর ৯ বছরের মধ্যে ৮ বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছর সংস্থাটি লোকসান গুনেছিল ২ হাজার ৭০৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এতে ৯ বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩) বিপিসির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা।
৯ বছরের মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা ছিল ৪ হাজার ২১২ কোটি দুই লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৬ হাজার ৬৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৮ হাজার ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৫ হাজার ৬৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ হাজার ৯২ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
Discussion about this post