বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) এর মধ্যে লড়াই শুরু হয়েছে গত অক্টোবরে। ১৯ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর অভিযানের এক পর্যায়ে কেএনএফের মুখপাত্র ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তা দিয়ে পিছু হটার ঘোষণা দিয়ে পালিয়ে যায়। সেখানে তারা বলে স্থানীয় জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা পিছু হটেছে।
যদিও শুরু থেকেই জোর সন্দেহ ছিল এই বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে ভারত। কিন্তু এর অফিসিয়াল কোনো তথ্য ছিল না। গত মঙ্গলবার অর্থাৎ ২২ নভেম্বর পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশ মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার সভাপতিত্বে মিজোরাম মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে চিন-কুকি-মিজো সম্প্রদায়ের অন্তর্গত উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং “অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সুবিধা অনুযায়ী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবরটি ২৪ নভেম্বর ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’সহ ভারতের সকল মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।
যদিও এখানে উদ্বাস্তুদের কথা বলা হয়েছে, তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে শুধুমাত্র কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির জঙ্গী সদস্যরাই ভারতের আশ্রয়ে গেছে। কোনো সাধারণ নাগরিক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যায়নি। তারা দেশেই আছে। কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির দাবিও তাই। তারা বলেছে তারা সাধারণ কুকি চীন উপজাতি বাসিন্দাদের বিপদে ফেলতে চায় না বিধায় তারা যুদ্ধ না করে পিছু হটেছে।
মিজোরাম সরকার ইতোমধ্যে সকল পলাতক জঙ্গীকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসএফ রেসকিউ টিম তৈরি করে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির সদস্যদের মিজোরামে থাকার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে বিএসএফ ও ভারতীয় আর্মির প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সহায়তায় দ্রুতই তারা বাংলাদেশে অস্থিরতা ও গোলযোগ তৈরি করবে।
মিজোরামের মানুষদের সাথে কুচি-চীন জাতিগোষ্ঠীর যতটা নৃতাত্ত্বিক মিল রয়েছে তার চাইতেও বেশি সাদৃশ্য রয়েছে ধর্মে। মিজোরামের প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান। মিজোরাম ভারতের একটি খ্রিস্টান রাজ্য। এদিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মিও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে একটি খ্রিস্টান রাজ্য বানানোর জন্য লড়াই করছে। এজন্য মিজোরাম আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তা নিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।
ঘটনার সূত্রপাত কুমিল্লা থেকে। কুমিল্লার কিছু তরুণ ছাত্র ঘর থেকে পালিয়ে গেল। পরিবারগুলোর অভিযোগের ভিত্তিতে সেই কেইসগুলো একত্র করে প্রশাসন বুঝতে পারলো এরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজছাত্র নিখোঁজ হয়। কিছুদিন পর তাদের একজন ফিরে এলে এই তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়ার বিষয়টি জানাজানি হয়। এর কদিন পর কুমিল্লা শহরের কুবা মসজিদের ইমাম শাহ মো. হাবিবুল্লাহ আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ৫ অক্টোবর সাতজনকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁদের মধ্যে কুমিল্লার দুজনসহ নিখোঁজ চার তরুণ ছিলেন। বাকি তিনজন জঙ্গি সংগঠক ও আশ্রয়দাতা।
আটকদের দেওয়া তথ্যমতে র্যাব ৯ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তিন তরুণসহ ২ নেতাসহ পাঁচজনকে র্যাব গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে নেতা ছিল হাবিব ও নেয়ামতউল্লাহ।
১০ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজরতের নামে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ৩৮ জনের তালিকা দেয়। এরপর পাহাড়ে অভিযান চালানোর কথা জানায় র্যাব।
আটককৃতরা বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা তৈরিসহ পাঁচ ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে প্রশিক্ষণ সম্পর্কে পাহাড়ের তথ্য দিয়েছেন। তারা জানিয়েছে তাদের দলের নাম ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’। হরকাতুল জিহাদ এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৯ সালে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া (যার বাংলা অর্থ—পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল) নাম দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
তারা হিজরতকারীদের টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করেন। যে তরুণেরা পরিবার ছেড়ে আসতেন, তাঁদের পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। সেখানে তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউসে রেখে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এ ছাড়া আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাঁদের রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
চরাঞ্চলে এসব প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হতো পাহাড়ে। সেখানে অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরি ছাড়াও চোরাগুপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রশিক্ষণ চলছিল।
খবর পেয়ে দুর্গম পাহাড়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে র্যাব ও সেনাবাহিনী। আরো চমক অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠন থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে হিন্দাল শারক্বিয়া। আল কায়েদাপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের! তাদের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সদস্যরা টাকার বিনিময়ে তাঁদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিতো।
মাসিক তিন লাখ টাকার বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া। তিন বছরব্যাপী এ প্রশিক্ষণের বিষয়ে ২০২১ সালে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিদের আমীর আনিসুর রহমানের চুক্তি হয়েছিল।
কেএনএফ সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ নিজেদের দাবি আদায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিশেষত আমেরিকাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি-চিন রাজ্যে হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়ে কেএনএফ বলেছে, দাবি পূরণ না হলে সশস্ত্র হামলা চালাবে। কেএনএফের দাবি অনুসারে তাদের সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য চার হাজার। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে সক্রিয়। গত ২৮ মে তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যের মানচিত্র ফেসবুক পেজে প্রকাশ করে তারা। কেএনএফ সদস্যরা খৃস্টান ও তারা তাদের অধীকৃত অঞ্চলে খৃস্টান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়।
অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় হলো উগ্র পাহাড়ী খৃস্টান সন্ত্রাসী আর আল কায়েদাপন্থী খারেজি সন্ত্রাসীদের মধ্যেকার সমন্বয়। সাধারণ দৃষ্টিতে তাদেরকে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন মনে হলেও তারা আসলে বন্ধুভাবাপন্ন। তাদের গডফাদার কারা? কারা তাদেরকে একত্র করে দেয়? কারা তাদেরকে পুতুল বানিয়ে সন্ত্রাসী বানাচ্ছে?
বিশ্বব্যাপী খৃস্টান মিশনারিরা পূর্ব তিমুরের মতো বাংলাদেশকে দ্বিখন্ডিত করার পরিকল্পনা করছে। তারা একইসাথে জঙ্গী দমনের নামে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ ও খৃস্টানদের অধিকারের নামে তাদের হয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে চায়। একইসাথে খারেজি সন্ত্রাসী ও খৃস্টান পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের উস্কে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
Discussion about this post