৫ জানুয়ারি ২০১৭। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়ান্দা সংস্থা ডিজিএফআই ঐদিন সকালে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং এমডিকে ফোন করে পদত্যগ করতে বলে। প্রথমে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিজিএফআই সদর দপ্তর ঢাকা ক্যান্টমেন্টে নিয়ে আসা হয়।
সেখানে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাদের পদত্যাগ পত্র এগিয়ে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন। বাধ্য হয়ে তারা পত্রে স্বাক্ষর করে চলে আসেন। এর পর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি হোটেলে (হোটেল রেডিসন ব্লু ) সভা ডেকে ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়।
সরকার মূলত বহুদিন থেকেই ব্যাংকটি দখল করতে চেষ্টা করছিলো। ব্যাংক দখলে এটির মূল শেয়ার যাদের সেই ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবিকে অন্ধকারে রাখা হয়। তারা অভিযোগ করেছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনে নিয়ম নীতির বালাই ছিলো না। তাদের জানানো হয়নি। মাত্র তিন দিন আগে মিটিং-এর খবর দেওয়া হয়। ফলে তাদের পক্ষে যোগদান সম্ভব ছিলো না।
সেনাবাহিনীকে দিয়ে বন্দুকের নলের মুখে ব্যাংক দখল করার খবর দেশের কোনো গণমাধ্যম আমাদের জানাতে পারে নি। অর্থাৎ তাদের জানাতে পারে নি নিরাপত্তার ভয়ে। এটি আমরা জানতে পারি লন্ডন ভিত্তিক বিখ্যাত সাপ্তাহিকী দ্য ইকনোমিষ্ট থেকে। তারা ৬ এপ্রিল ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের ক্যু নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল ‘The government initiates a coup at Bangladesh’s biggest bank’।
এভাবেই শুরু হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের দুর্ভাগ্যের সূচনা। গতমাসেও অর্থাৎ অক্টোবরে এই ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে (প্রায় ৫২%)। প্রায় ৭ বছর আগে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপ যখন ইসলামী ব্যাংক দখল করে তখন ইসলামী ব্যাংকে মানুষের আমানত সবচেয়ে বেশি ছিল। মালিকানা দখল করে এস আলম গ্রুপ নামে বেনামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জামানত ছাড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ইসলামী ব্যাংক থেকে।
এই পত্রিকা চলমান ২ অক্টোবর ২২ সালে আমাদের সময় পত্রিকায় রিপোর্ট হয় ‘আইন ভেঙে নাবিল গ্রুপকে ৬৩৭০ কোটি টাকা ঋণ’। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায়,
গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ হিসেবে ব্যাংকটি একটি গ্রুপকে সর্বোচ্চ দিতে পারবে ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কিন্তু নাবিল গ্রুপকে দিয়েছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন করে মাত্র চার মাসের মধ্যে এসব ঋণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত জামানত ও ডকুমেন্টও রাখা হয়নি। ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়।
আজকে অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর ২০২২ তারিখে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে লিড নিউজ করে প্রথম আলো। এখানে তারা উল্লেখ করে, নাবিল গ্রুপের জন্য যে অবৈধ ঋণ অনুমোদন করে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তার ২৪৬০ কোটি টাকা এই নভেম্বর মাসেই তুলে নেয় নাবিল গ্রুপ।
ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ নামে আজকের প্রতিবেদনে প্রথম আলো লিখেছে, ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। সব মিলিয়ে নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর।
শুধু নাবিল গ্রুপ নয়, ইসলামী ব্যাংক থেকে পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় আরো হাজারো কোটি টাকা বিনা জামানতে ও ভুয়া কাগজ দেখিয়ে তুলে নিয়েছে বহু বেনামী প্রতিষ্ঠান। প্রথম আলো বলেছে, ইসলামী ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো শিল্প গ্রুপগুলো ছিল ব্যাংকটির গ্রাহক। মালিকানা পরিবর্তনের সাত বছরের মাথায় ভালো গ্রুপগুলো ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর শীর্ষ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বল্প খ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে ব্যবসায় ঋণ দিয়েছে, তা যথাযথ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থনীতি সংকটের সময় এমন বড় অনিয়ম হলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগী হয়ে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওপরের নির্দেশের জন্য বসে থাকলে চলবে না।’
এভাবে ব্যাংক লুটের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলো আওয়ামী সরকার। শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী করতে কিছু শিল্প গ্রুপ, সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ডাকাতি করার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। এই লুটেরা গোষ্ঠীর ওপর টিকে আছে স্বৈরাচার হাসিনা। লুটেরা গোষ্ঠী জনগণের টাকা লুটপাট করে একের পর এক ব্যাংককে দেউলিয়া করে দিচ্ছে। জনগণের কষ্টের টাকা হাওয়া করে দিচ্ছে। এর আগে বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছে। এখন এই পথে যাত্রা শুরু করে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক।
Discussion about this post