বাংলাদেশে আদমশুমারি হয়ে গেল। যদিও অনেক বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। টোটাল সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিকলনা মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন আদমশুমারি কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে। এই বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। আজকে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে। আর সেটা হলো বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
এই নিয়ে প্রায় সব মিডিয়া অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে। কেউ কেউ ইতিহাস টেনে নিয়ে অনেক বিশ্লেষণী রিপোর্ট করেছে। এসব বিষয় এতটা গুরুত্ব না পেলেও বুয়েটের শিক্ষক এনায়েত চৌধুরীর গত বুধবারের ভিডিও বরাবরের মতোই ভাইরাল হয়। তিনি হিন্দু কমে যাচ্ছে এই নিয়ে ভিডিও তৈরি করেছেন।
তিনি তার বিশ্লেষনে কয়েকটি বিষয়কে ফাইন্ড আউট করেছেন যার দ্বারা হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
১। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মাইগ্রেশন (মুসলিমরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করছে)
২। এনিমি সম্পত্তি দখলের ফলে মাইগ্রেশন (আবুল বারাকাতের মতে হিন্দুদের জমি দখল করার কারণে এটা হয়)
৩। ফার্টিলিটি রেইট (এই সমস্যার কথা উল্লেখ করে ছেড়ে দিয়েছেন। এনায়েত এই কারণকে গুরুত্ব দেননি)
এনায়েত চৌধুরীর ভাষ্যমতে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার বেসিক কারণ হলো ভারতে মাইগ্রেশন। কিন্তু আসলে কি তা হয়?
এদেশে হিন্দুদের অবস্থা, জীবন যাপন প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের চাইতে অনেক ভালো। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৮% শতাংশ হলেও সরকারি চাকুরিতে হিন্দুদের পরিমাণ প্রায় ২২%। এখান থেকে সাধারণত হিন্দুরা যায় না। যারা মাইগ্রেশন করে তারা মূলত এখানে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছে এবং যাদের কালো টাকা আছে তারা ভারতে সেগুলো পাচার করে ও এক পর্যায়ে নিজেদের মাইগ্রেশন করে। এই সংখ্যাটা নিতান্তই কম। এটা ধর্তব্য নয়।
ধরে নিলাম এনায়েতের বিশ্লেষণ ঠিক। পাকিস্তানেও হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৌদ্ধপ্রধান শ্রীলংকায়ও হিন্দুদের পার্সেন্টেজ কমে যাচ্ছে। এনায়েতের হিসাবকে সত্য হিসেবে ধরে নিলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে দলে দলে মানুষ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। এদিকে ভারতের হিন্দুদের তো মাইগ্রেশনের ঝামেলা নেই।
এনায়েত ও বারাকাতের হিসেবে ভারতে হিন্দুদের পার্সেন্টেজ লাফিয়ে বাড়ার কথা। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে সেখানে? ভারত থেকে দাঙ্গা কিংবা এনিমি সম্পত্তি দখলের কারণে মাইগ্রেশন নেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার হিন্দুরা সেখানে যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে নেপাল থেকেও কেউ কেউ ভারতে মাইগ্রেশন হচ্ছে।
এত হিন্দু চারদিক থেকে ভারতে এলেও ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমি যে ছবিটি শেয়ার করেছি সেটা ভারতের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার তুলনামূলক চিত্র। এটি দ্য হিন্দু পত্রিকা থেকে নিয়েছি। এখানে দেখা যাচ্ছে ভারতে ১৯৫১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৪%। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯%এ। ভারতের বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে ৫% কমে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার!
এনায়েত ও বারাকাতেরা মাইগ্রেশনে যে চিত্র দেখিয়েছে তা যদি সঠিক হতো তবে কি ভারতে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমে যেত? অন্যদিকে খেয়াল করুন ভারতে মুসলিমদের পার্সেন্টেজ বেড়ে গেছে। ১৯৫১ সালে তা মুসলিমরা ছিল ৯.৮%। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৪.২%। প্রায় সাড়ে ৪% বেড়ে গেছে।
ভারতে মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা কয়েকটি স্থানে কিছুটা ভালো। বাকী পুরো ভারতে মুসলিমদের যুদ্ধ করে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। ভারত থেকে কিছু মুসলিম মাইগ্রেশন হয় মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে। কিন্তু তারপরও সেখানে মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ছে ও হিন্দুদের জনসংখ্যা কমছে।
একপাক্ষিক ও পূর্ব ধারণা মাথায় রেখে বিশ্লেষণ করার কারণে এনায়েত চৌধুরির বিশ্লেষণের মৌলিক ত্রুটি দেখা গেছে। যদি মাইগ্রেশনই মূল সমস্যা হতো তবে ভারতে হিন্দু সংখ্যা বেড়ে যেত।
হিন্দুরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে ১ম দেশ ভারতে, এরপর নেপালে এবং ৩য় দেশ বাংলাদেশ। অবাক করা ব্যাপার হলো এই তিন দেশেই জনসংখ্যা কমছে। ভারত ও নেপালে মাইগ্রেশন সমস্যা নেই। তবুও কেন কমছে?
এর বেসিক কারণ হলো ফার্টিলিটি রেট। যে বিষয়টা এনায়েত উল্লেখ করেও গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে গেছে। অথচ এটাই হচ্ছে বেসিক কারণ।
হিন্দুদের ফার্টিলিটি রেট বা জন্মহার কমে যাওয়ার কারণ দুইটি
১। জন্মনিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় প্রভাব নেই
২। তাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
ফার্টিলিটি রেট জলবায়ু ও অঞ্চলের ওপর বেশি নির্ভর করে। আমাদের অঞ্চলের চাইতে আফ্রিকায় ফার্টিলিটি রেট বেশি। একই এলাকার দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে এর পার্থক্য হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু দুই কারণে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা প্ররোচনায় প্রচার করা হচ্ছে জনসংখ্যাই আমাদের সমস্যা। এজন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই প্রচারণার সাথে একমত হয় নি মুসলিমরা। কিন্তু হিন্দুদের তাতে সমস্যা ছিল না। মুসলিম সমাজের মসজিদে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে হামেশাই বক্তব্য দেওয়া হয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মওদূদী এই নিয়ে বই লিখেছেন ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ’।
এই বইটি উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রজেক্টটা বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে অল্প কয়েকদিন হচ্ছে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু হিন্দু সমাজে এটা গোড়া থেকেই জনপ্রিয় ছিল। তারা পশ্চিমা প্রচারণায় কান দিয়েছে। তাই তাদের জন্মহার কমে গিয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো তাদের খাদ্যাভ্যাস। এই উপমহাদেশের হিন্দুরা লাল গোশত খুবই কম খায়। গরু ছাগলের গোশত কম খাওয়ায় তাদের ফার্টিলিটি রেট কমে যাচ্ছে। গরু ছাগলের গোশতে (রেড মিট) প্রচুর জিংক থাকে। যা সন্তান জন্মদান ও গর্ভধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘসময় ধরে গোশত না খাওয়ায় ফার্টিলিটি রেট কমে যাচ্ছে।
তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব স্থানে, সব দেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় হিন্দু সংখ্যা কমছে। এই বিষয় নিয়ে ভারতের লোকেরাও গবেষণা করেছে। তারা এই ফার্টিলিটি রেটকেই ফাইন্ড আউট করেছে কারণ হিসেবে।
Discussion about this post