অলিউল্লাহ নোমান
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটে রাজাপাকসে পরিবারের পতন ঘটেছে গণবিক্ষোভে। পতনের পর পালিয়ে গেছেন দেশটির ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। ৯ জুলাই প্রথমে প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন অজ্ঞাতস্থানে। জনতা ভবনটি দখলে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করে সেদিন। এরপর দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কলম্বোর বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্টসহ দেশটির অর্থমন্ত্রীকে। অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে প্রেসিডেন্টের আপন ভাই। তবে ১৩ জুলাই গোতাবায়া ও তাঁর স্ত্রী দুই দেহরক্ষী নিয়ে দেশটির বিমান বাহিনীর একটি উড়োজাহাজে করে মালদ্বীপে নেমে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্য, মালদ্বীপের জনগণ তাঁকে গ্রহণ করতে সম্মতি দেয়নি।
গোতাবায়াকে বহিষ্কারের দাবী উঠে দেশটির জনগণের পক্ষ থেকে। এক পর্যায়ে ১৪ জুলাই সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে করে মালদ্বীপ ছাড়েন। সিঙ্গাপুরে আপাতত আছেন গোতাবায়া ও তাঁর স্ত্রী। এর আগে ৯ মে গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে গণবিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন।
রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যদের এই পরিণতি দেখে অনেকেই এখন প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের অবস্থা কি হবে? বাংলাদেশও কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটবে?
গত ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা দাম্ভিক শাসক পরিবারের পরিণতিও কি মাহিন্দা ও গোতাবায়াদের মতই হবে? আমার দেশ-এ প্রকাশিত শ্রীলঙ্কার নিউজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও’র নিচে কমেন্টস বক্সে অনেকেই এমন প্রশ্ন করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন টকশোতেও এমন প্রশ্ন উঠতে দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাটেও মানুষ প্রশ্ন করে জানতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের শাসক পরিবারের একই পরিণতি হবে কি না।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা গণতান্ত্রিকভাবে ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিজয়ের পর। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোতাবায়া রাজাপাকাসে। ভাই সাবিল রাজাপাকসে পান অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার ছেলেও ছিলেন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এই পরিবারের আরো অনেকেই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পান। জনগণের রায়ে বিজয়ী হয়ে পারিবারিক শাসন কায়েম করেছিলেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু তাদের পারিবারিক শাসনে লুটপাট এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটির অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে সুন্দর একটি দেশ। তাদের জিডিপিও ভাল ছিল। শিক্ষার হার শতভাগ। তারপরও অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির ফলে তলিয়ে গেছে সব। বিদ্যুৎ, জ্বালানীর চরম সঙ্কটের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষ হয়ে পড়েছিল দিশেহারা। অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে জ্বালানী আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না সরকারের পক্ষে। মানুষের পীঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পর রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। ভোটে নির্বাচিত জনপ্রিয় এই এই ব্যক্তিরাই জনরোষের মুখে পড়েন। যে মানুষ গুলো তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল, রাষ্ট্র পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে সেই মানুষই রাস্তায় নামে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদি শাসকদের পরিণতি শ্রীলঙ্কার মতই হবে কিনা।
প্রথম: বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন শাসক পরিবার জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রেখেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান শাসক পরিবারকে জনগণ ক্ষমতা দেয়নি। তাই শেখ পরিবার ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভিন্নমতকে দমন করছে নিষ্ঠুরভাবে। বিরোধী দলের সম্ভাবনাময় নেতা-কর্মীদের ধরে হয় গুম করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়ে। ভিন্নমতের গণমাধ্যমকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। মানুষের কথাবলা বন্ধ করতে তৈরি করা হয়েছে নানা কিসিমের আইন। অপর দিকে নিজেদের লুটপাট আর দুর্নীতি নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারেন, এজন্য ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে আইন বানিয়ে। একদিকে মানুষের কথাবলা বন্ধ করতে আইন। আরেক দিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের সহায়তায় ইনডেমনিটি।
দ্বিতীয়: শ্রী লঙ্কার চলমান এই আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। সেনাবাহিনীর বাঁধা উপেক্ষা করেই জনতা প্রধানমন্ত্রীর অফিস দখলে নিতে দেখা যায় ১৩ জুলাই (বুধবার)। বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী বরাবরই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদকে সহায়তা করতে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর নামের আগে দেশপ্রেমিক শব্দটা ব্যবহার করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। সেনাবাহিনীর সাথে দেশপ্রেমিক শব্দটি এখন অতীত হয়ে গেছে। জাতীয় সঙ্কটে ঐতিহাসিক কিছু ভূমিকার কারণেই সেনাবাহিনীর আগে দেশপ্রেমিক শব্দটার ব্যবহার করত মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আগের এই জায়গায় নেই। তাই মানুষ এ বাহিনীর নামের আগে দেশপ্রেমিক শব্দটা আর তেমন ব্যবহার করে না। কারণ, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়েই শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জেনারেল মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ার সাথে সমঝোতার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরেও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছে। ভোটের আগের রাতে ব্যালটে নৌকায় সীল মারা হয়েছে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সহযোগিতায়।
শ্রীলঙ্কার ভোটে এরকম কোন অভিযোগ উঠেনি। সুতরাং ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার শাসক পরিবার ও বাংলাদেশের মধ্যেই কিছুটা পার্থক্য আছে। কারণ, ক্ষমতা ধরে রাখতে শ্রীলঙ্কার শাসক পরিবার পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেনি বা ব্যবহার করতে সক্ষম হয়নি। বাহিনী গুলোর পেশাদারিত্বের কারণেই এটা হয়ত সম্ভব হয়নি শ্রীলঙ্কায়। কিন্ত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়ে বর্তমানে ভারতীয় এ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। বাংলাদেশ পুলিশের কথা না বলাই ভাল। পুলিশের আগে এখন গোপালী শব্দটির ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
উপরের এই দুইটি ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অপরদিকে সমস্যা ও সঙ্কটের দিকে তাকালে দুই দেশের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, (এক) শ্রীলঙ্কায়ও লোক দেখানো অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রাজাপাকাসে পরিবারের শাসকরা। এসব মেগাপ্রকল্পের আড়ালে লুটপাট করা সহজ হয়েছে। বাংলাদেশেও শেখ পরিবারের শাসনে অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ক্ষমতায় আসার পরপরই। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের খচর বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়েছে লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার কারণেই। যেমনটা হয়েছে শ্রীলঙ্কায়ও।
(দুই) শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমদানি ব্যায় মিটানোর মত রিজার্ভ ছিল না দেশটির ভাণ্ডারে। বাংলাদেশেও রিজার্ভে টান পড়েছে। প্রতি মাসেই রিজার্ভ কমছে। ২০২৩ সালের পর মেগা প্রকল্প গুলোর বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ফেরত দেওয়া শুরু হবে। তখন রিজার্ভে আরো বেশি টান পড়বে। বর্তমানে যে রিজার্ভের কথা বলা হয় তা দিয়ে ৩ থেকে ৪ মাসের বেশি আমদানি ব্যায় মিটানো সম্ভব নয়।
(তিন) রিজার্ভ শেষ হয়ে যাওয়া আমদানি বন্ধ করতে দিতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। এতে জ্বালানী সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এমনটি কাগজ আমদানি করতে না পারায় স্কুল-কলেজে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছিল দেশটিতে। বাংলাদেশে রিজার্ভে টান পড়ায় সরকার ইতোমধ্যে আমদানিতে সতর্কতা জারি করেছে। জ্বালানী আমদানির ব্যায় মিটানো সম্ভব নয় বিধায় বিদ্যুতের উৎপাদন কমে গেছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে তীব্রভাবে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস ও কয়লা লাগে। দেশের গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া প্রয়োজনীয় গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোতে সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। কয়লা আমদানি করতে প্রয়োজনীয় পর্যন্ত টাকা নেই। যেমনটা শ্রীলঙ্কায় শুরু হয়েছিল ২ বছর আগে। বাংলাদেশেও একই অবস্থা শুরু হয়েছে বর্তমানে।
(চার) দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ছিল শ্রীলঙ্কায়। আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বাড়ছিল অস্বাভাবিকভাবে। অপরদিকে মানুষ ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থামানো যাচ্ছে না। আওয়ামী লুটাপাটে এক শ্রেণীর কিছু সংখ্যক লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। খাবারের অভাবে ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যার খবরও পত্রিকায় বের হয় হচ্ছে। আওয়ামী দালাল মিডিয়া এ গুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে এসব খবর।
(পাঁচ) শ্রীলঙ্কায় একটি পরিবারের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতা। পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর। বাংলাদেশেও একটি পরিবারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা বন্দি হয়ে আছে। দেশে আইন ও সংবিধান কতটুকু মানা হবে সেটা নির্ভর করে এক ব্যক্তির ইচ্ছার উপর। তাঁকে সকল কাজে সমর্থন দেওয়ার জন্য দেশে তৈরি হয়েছে দালাল ও গোলাম মিডিয়া। এক শ্রেণীর কথিত সুশীলরাও ইনিয়ে বিনিয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতাকে।
সবশেষে বলা যায়, শ্রীলঙ্কার মত জাতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটের পথে বাংলাদেশ ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াই সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে লুটেরাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে। বাংলাদেশের মানুষ কতটা প্রস্তুত ব্যক্তি শাসনের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হতে তার উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যত।
লেখক: সাংবাদিক
Discussion about this post