সালাহউদ্দিন বাবর
আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের সীমা ও পরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক) বলা আছে – ‘১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যেসব এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা। কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদবহির্ভূত; এবং ২(খ) ‘যে সকল এলাকা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত হইতে পারে।’ এই বর্ণনা অনুসারে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশি এলাকা নিয়ে বাংলাদেশের পরিধি। বস্তুত দেশটি আমাদের আয়তনের দিক থেকে ছোট বটে। আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম একটি দেশ। তবে জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৮ম বৃহৎ দেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা আনুমানিক ১৭ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে।
যাই হোক, এই জনপদকে ছোট বলি আর বড়ই বলি, আমরা কিন্তু হাজারো সমস্যার আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি, হালভাঙা তরী যেমন মাঝ দরিয়ায় কেবলই ঘুরপাক খায়, তেমনই আমরাও খাচ্ছি। গত ৫০ বছরে ‘দেশের সমস্যা কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। দেশের মানুষ গত অর্ধশতাব্দী ধরে কেবল জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত, জীবনটা অবশ্য সংগ্রামের তথা যুদ্ধের। কিন্তু তার তো একটা ফল থাকে, স্বস্তি, শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যের। কিন্তু অহর্নিশ যুদ্ধের ফলতো কেবল ‘সকলই গরল ভেল’। পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে বলা হচ্ছে আমাদের আয়-রোজগার বাড়ছে, হয়তো বাড়ছে, কিন্তু প্রশ্নটা তো হলো, কাদের বাড়ছে, বড় জানতে ইচ্ছা করে। আমরা তো নানা গবেষণা নিবন্ধে দেখছি, মধ্যবিত্ত সমাজজীবন যুদ্ধের কশাঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে, দরিদ্র ক্রমেই হতদরিদ্র হচ্ছে। আমরা সাধারণরা তো দেখি সরকারি সেবা কিনতে গাঁটের সব পয়সাই দিতে হচ্ছে।
আর কোথাও থেকে আয় বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে সব সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের আয় বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় রয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাস ভাড়া, ট্রেন ভাড়া বাড়িয়ে চলছে। অর্থাৎ দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবার মাথায় মুগুর মারা হচ্ছে, মনে হয় কর্তৃপক্ষ ভাবে, এরা সবাই সর্বংসহা। অন্য দিকে অপচয়, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার অতীতের সর্ব রেকর্ড ‘ব্রেক’ করে বসে আছে। বলা হচ্ছে উন্নতি হচ্ছে, হ্যাঁ হচ্ছে মেট্রো রেল হচ্ছে, পাতাল রেল, ট্যানেল হচ্ছে। অথচ গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটের কী বেহালদশা, ব্রিজ, কালভার্ট সব জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ছে, নদীর পাড় ভাঙছে, মানুষের বসতবাড়ি জমিজমা নদীতে বিলীন হচ্ছে। স্কুল-মাদরাসাগুলোর কাহিল অবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার কী ভয়ানক দৈন্য। অথচ এসব গ্রামগঞ্জেই দেশের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন কী নিদারুণ বৈষম্যের শিকার হয়ে। এসব মানুষই দেশের জন্য খাদ্যশস্য শাকসবজি ফলান। কিন্তু পরে পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন, তাতে খরচ ওঠে না। কয়েক হাত ঘুরে তা যখন জেলা সদরে, বড় শহরে, রাজধানী আসে, সেটাই অগ্নিমূল্যে বিক্রি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য-সবজি ফলায়ে এখন রিক্ত নিঃস্ব হচ্ছে। মাঝে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভের গুড় শতভাগই খাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা এর কি একটা সমাধান দিতে পারে না? বাজারজাতের একটা বিকল্প ব্যবস্থা জরুরি ব্যবস্থা করে কৃষিজীবীর স্বার্থটা সংরক্ষিত করা যায় না? এমন পরিকল্পনা নেয়া হলে উৎপাদনকারী ও ভোক্তা সমভাবে লাভবান হতো।
এ দিকে জাতীয় দৈনিকগুলো পরিকল্পনা কমিশনের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে, দেশের মানুষের নাকি মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বছরে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৯১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক আয় ২৭ হাজার ৯৫৫ ডলার। এটা টাকায় যদি রূপান্তরিত করা হয়, এক ডলার সমান ৮৬ টাকা ধরে, সে হিসাবে ওই পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ২৪,০৪১৩ টাকা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোভিডের ভয়াবহ ছোবলে অসংখ্য মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন, বহু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন তাদের প্রতিষ্ঠান কমিয়ে দিয়েছে, কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আয় রোজগার এতটা কমেছে যে, তারা এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুর্ভোগে। অথচ পরিকল্পনা কমিশন বলছে, মানুষের আয় বেড়েছে, হয়তো বেড়েছে; কিন্তু কাদের বেড়েছে? সেই ভাগ্যবান যারা কোভিডের সময়ে পরিস্থিতি সুযোগ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে দুই নম্বরি করা থেকে এককাঠি উপরে উঠে এখন তিন নম্বরি করেছেন, তাদের আয়-রোজগার অবশ্যই চতুর্গুণ বেড়েছে। এ দিকে জনগণের সঙ্গীন অবস্থা অন্য দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে যত অনিয়ম তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা আছে কি! প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অংশবিশেষের কথা স্মরণে আসছে ‘চোখ তো অন্ধ নয় বরং বুকের মাঝের হৃদয় অন্ধ’ (সূরা ২২ : আয়াত ৪৬)। হৃদয়টা যদি নিকষ কালো হয়ে থাকে তবে সেখানে স্বচ্ছতা আসবে কিভাবে? তারা আর কী দেখবে। তাদের বিবেচনা তো উবে গেছে।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর উদ্ধৃত করছি। সেটা পাঠ করে তা থেকে মনে যে বোধ সঞ্চারিত হয়েছে, তা হৃদয়বান পাঠকদের সাথে শেয়ার করার বাসনা পূরণ করতে চাই। শিরোনাম হচ্ছে ‘সিটি করপোরেশনে দক্ষ চালক নিয়োগের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর।’ খবরের বিস্তারিত হচ্ছে ‘সিটি করপোরেশনে দক্ষ চালক নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
তিনি বলেছেন, ময়লার গাড়ির চালকের কারণে সম্প্রতি রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সে রকম যেন আর না হয়।’ খবরের এতটুকু থেকে দু’টি বিষয় মনে জাগ্রত হয়েছে, প্রথম হলো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি সব দিকেই যে খোলা সেটা একটি ইতিবাচক দিক। দ্বিতীয়ত. প্রশ্ন হচ্ছে সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এত ওপর থেকে কথা বলতে হবে কেন? তাদের দায়-দায়িত্বের এত ঘাটতি থাকলে এসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যে তিমিরে পড়ে আছে সেখানেই তাকে পড়ে থাকতে হবে। তারা নগরবাসীকে কিভাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে সক্ষম হবেন? করপোরেশনের আর এ খবর হয়তো দৃষ্টি এড়ায়নি। সেটা হলো – ময়লার গাড়ির চালকরা বহু ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নেন। সেই চালকরা এত হেভি ভেহিকেল চালানোর ক্ষেত্রে দক্ষ কিনা, তাদের যথাযথ লাইসেন্স রয়েছে কিনা তা কে জানে। এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা পাওয়ার জন্যই দুই নগর পিতা তথা মেয়রদ্বয়কে নাগরিকগণ নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রশাসনের কাছ থেকে রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকগণ সর্বনিম্ন সেবাটাই পাচ্ছেন। তাই জিজ্ঞাসা – দুই করপোরেশন আগামীতে কেমন ও কতটুকু সেবা তারা মানুষকে দিতে পারবে?
প্রসঙ্গটা উঠেছে দক্ষ গাড়িচালক নিয়ে। এ দিকে সড়কের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক দুঃখের কাহিনী রয়েছে। নিরাপদ সড়ক চেয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চলছে, তা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মানুষ ঘর থেকে বের হয় কাজের জন্য। কাজ শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরবে – এটাই পরিবার-পরিজনদের আশা। কিন্তু এখন তো সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ পেতে বসে আছে বাস-ট্রাক, অন্যান্য যন্ত্রচালিত যানবাহন। সম্প্রতি কক্সবাজারে পিতার শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বাড়ি ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ সহোদর ভাইয়ের প্রাণ কেড়ে নেয় এক গাড়ি। এখন এই পরিবারের আর কী অবশিষ্ট থাকল? তাদের পরিবার যে নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হলো তার কী প্রতিকার হবে! এরপর দিন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের হাইদচকিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর দুই ছাত্রীকে একটি যান চাপা দেয়, ঘটনাস্থলেই দুই সহপাঠীর প্রাণ যায়। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে এক ছাত্রকে ট্রাক চাপা দিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ-তো দুই-একটি ঘটনা মাত্র, অথচ প্রতিদিন দেশে বিভিন্ন স্থানে সড়কে যানবাহনে পিষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে চলেছে। গত ছয় মাস আগে দেশে ৪১৮ ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। সড়ক মানুষের জন্য নিরাপদ করতে কী ব্যবস্থা হচ্ছে, মানুষের তা জানার অধিকার আছে। তা ছাড়া সড়কে আরো কত অনিয়ম অব্যবস্থাপনা রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মহাসড়কে দ্রুতগামী বাস ট্রাকের পাশাপাশি চলছে স্বল্প গতির নানা যানবাহন; এসবও দুর্ঘটনার কারণ। মহাসড়কে পণ্যবাহী, যাত্রীবাহী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত টাউট মাস্তানরা। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগ।
প্রতি ১০ বছর পরপর আদমশুমারি করার নিয়ম থাকলেও সেটা হচ্ছে না। অথচ আদমশুমারির মাধ্যমে প্রকৃত জনসংখ্যা পাওয়া গেলে; দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিষেবা নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে সেটা বাস্তবভিত্তিক হয়; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কি? দেশে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে, তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন। পূর্ববর্তী শুমারি থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৯৭ শতাংশ। সব চেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল ঢাকা বিভাগে, সংখ্যাটা চার কোটি ৭৪ লাখ ২৪ হাজার ৪১৮ জন। কম জনসংখ্যা ছিল বরিশাল বিভাগে, ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৬ জন। গত শুমারির ১২ বছরের মাথায় এখন জনসংখ্যা অবশ্যই বেড়েছে। তবে গত দুই বছরে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি ’২২ পর্যন্ত ২৮ হাজার ৭৯১ জন। কিন্তু কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রকৃতপক্ষে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক হিসাব কারোই জানা নেই। তবে সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। তাতে মোট জনসংখ্যা কিছু তো কমবেই, বহু দেশেই এমন ঘটেছে। যাই হোক এখন অনুমান করে দেশের জনসংখ্যা যা নির্ণয় করা হয়েছে, তাতে প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৮৮৯ জন। সরকারি হিসাব অনুসারে দেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ যারা কিছু লিখতে-পড়তে পারেন, তাদের শতকরা হিসাব হচ্ছে ৬৫ শতাংশ। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও নানা হিসাবে বহু গরমিল আছে। তাই আমাদের সত্যিকার শিক্ষিত জনশক্তি কত, আর আমজনতার সংখ্যা ৩৫ শতাংশ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, প্রকৃত ‘জনশক্তি’র সঠিক হিসাব কত, জানা না থাকলে কোনো পরিকল্পনা করা কঠিন, সেই ‘আমজনতার’ সংখ্যাটা বৃদ্ধি রোধ করার কোনো উদ্যোগ সস্পর্কে তো কিছু জানা যায় না। তা ছাড়া জনশক্তি আর জনসম্পদের মধ্যে তফাৎ আছে। জনশক্তি তখনই জনসম্পদে পরিণত হবে যখন কোনো কর্মে দক্ষ, বিভিন্ন ‘ট্রেডে’ প্রশিক্ষিত। এ ব্যক্তিদের নিয়ে দেশ গঠনের কাজ হতে পারে। জনশক্তি নিয়ে এখন বেশি কিছু ভাবা হয় না। তাদের নিয়ে কোনো ‘প্রেডিকশন’ করা যায় না। কারণ আমজনতা মুহূর্তেই উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়ে অঘটন ঘটাতেই পারে। অন্যদের সাধু সিদ্ধবা বলি কী করে। কোভিডকালে প্রতিনিয়ত এমন সব কর্মকাণ্ড হচ্ছে যা প্রায়ই সর্বত্র দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধি তোয়াক্কা করছেন না কেউই। দেশের সব মানুষকে যদি জনসম্পদে পরিণত করার সত্যিকার চেষ্টা থাকত, তবে স্বাধীনতার পরপর, গত পাঁচ বছরে এ কাজে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
এ জন্য দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে, যে দল ‘নির্বাচন’কে ‘মোকাবেলা’ করে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের প্রাক্কালে দলে পেশ করা ‘ইশতেহারে’ জনগণকে হাজারো প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস দিয়ে থাকে তারা। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসে সব ভুলে যায়। ক্ষমতার ‘কুরসিতে’ বসে সে কুরসির ‘ওমে’, এর সুখবোধে সব কথাই ভুলিয়ে দেয় তাদের। তবে এতটুকুও ভুলে যায় না, তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ নিরঙ্কুশ করতে প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে দলনে কালক্ষেপণ করে না। অন্য কথা না হয় থাক, এতটুকু একান্ত প্রয়োজন ছিল জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা আর জনতাকে জনশক্তিতে পরিণত করা। এতেও এই জনপদের অনেক সমস্যার সুরাহা হতো। দেশে অনেক কিছুরই অভাবের মধ্যে জনসম্পদের অভাবটা কম কিছু নয় বরং মৌলিক একটা ব্যাপার। সত্যিকার জনসম্পদ যে মানুষ, হৃদয়ের ভেতর লুকায়িত থাকে মানবিকতা। তার বিকাশ ঘটলে সে জানবে রাষ্ট্রের কাছে তার কী অধিকার আর ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ ও রাষ্ট্রের কী অধিকার তার ওপর গচ্ছিত রয়েছে। আর সেজন্য এসব পরিশীলিত মানুষকেই প্রয়োজন দেশের খেদমতের জন্য। তারা দেশের কোনো দায়িত্বে আসীন হলে সমাজ রাষ্ট্রে যে অনিয়ম অব্যবস্থা সেটা দূর করা অনেকটা সম্ভব হতো। সমাজে অবস্থানকারী এসব আলোকিত মানুষ বেছে নেয়ার একটি মাত্র পথ আর সেটা হচ্ছে প্রশ্নহীন স্বচ্ছ নির্বাচন। পরিবারে কোনো সদস্য অপেক্ষাকৃত গুণপনায় এগিয়ে আছে তা শুধু পরিবার নয় মহল্লা, গ্রাম, অঞ্চল সবার কাছে তার সদগুণ, সত্যনিষ্ঠতা, কালোকে কালো বলেই জানা, দায়িত্ব পাওয়া আমানত হিসেবে জ্ঞান করে পরসেবায় আত্মনিয়োগ করা হতো তার নীতি। এসব কারণে সবাই তাকে উত্তম হিসেবে বিবেচনা করবে। এভাবেই যদি দেশের সব এলাকায় এমন সব মানুষকে বেছে নেয়ার অধিকার জনগণের বহাল হয়, তথা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। দুর্নীতি জোচ্চুরি যথেচ্ছাচার, সমাজ রাষ্ট্রের সম্পদ গ্রাস-পাচার বন্ধ হতো। দায়িত্ব হাতে পেলে তারা পাহারাদার হয়ে মানুষ, সমাজ ও দেশের সত্যিকার সেবক হতো। এখন এর প্রচণ্ড অভাব।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় নিজেদের দলের জন্য এমন সজ্জন, যারা পরার্থে নিবেদিতপ্রাণ, নেতাদের খুঁজে নিত, তবে দেশের অনেক কল্যাণে তারা আসতে পারতেন। এমন লোক থেকে দলের কাছে নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাচ্ঞা করবে না, ছুটে আসবে না, তাদের কাছে দলকে যেতে হবে। এখন বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের নেতাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম অন্যায় পথে চলে, দেশের নয়, দশের নয় নিজে ভোগ-বিলাস ও আখের গোছানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। তেমন হয়তো হতো না। দল যেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, সেই সাথে দেশের মানুষ দলের প্রতি আস্থাশীল হতো, দলকে সমর্থন সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকত। এখন ক্ষমতায় আসতে দলকে যত ছলাকলা, কৌশল অনৈতিক পথের আশ্রয় নিতে হয় সেটার আর প্রয়োজন পড়ত না। আজকাল যেভাবে দলগুলো ক্ষমতা লাভ করে মসনদে বসে তাতে তাদের বুকের ভেতর যে হৃদয়টা আছে, সেটা গ্লানিতে ভরে আছে। সুস্থ প্রক্রিয়ায় নেতা হয়ে যারা আসেন, তাদের কাজে-কর্মে যে সৌরভ সৌন্দর্য বেরিয়ে আসত সেটার বিচ্ছরণ ক্ষুব্ধ মানুষকে আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে তুলত, নবতর চেতনায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হতে পারত।
এমন সব নেতৃত্ব সমাজ ও সমাজের মানুষকে আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বলতর করে তুলতে পারত। তাদের সংস্পর্শে সমাজের সাধারণ মানুষ এখন অসাধারণ হয়ে উঠত। তারা যদি ভুলক্রমেও অনিয়মে, চৌবাচ্চায় পড়ে তবে তৎক্ষণাৎ বিবেকের তাড়নায় সেখান থেকে উঠে আসার জন্য অবিরত চেষ্টায় নিয়োজিত হতো। এখন সমাজ যে পঙ্কিলতায় ভরে আছে, আমাদের নেতারা সে দিকে চোখ মেলে তাকান না, তা অপসারণের কোনো কোশেশ করেন না। এসব সবার অলক্ষ্যে তারাই তো কামাই করছেন। জাতীয় জীবনের এমন সব জঞ্জাল দেখে কেউ আর স্বস্তি বোধ করেন না। তবে এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। সেই অতীতে বঙ্গবন্ধু বেদনায় কাতর হয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আমি তো সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ পাইনি।’ আমাদের তেমন মানুষ নেই যিনি ‘কথায় না বড় হবে, কাজে বড় হবেন।’ আমরা মূলত জাতি হিসেবে ‘টকেটিভ’; কাজের ক্ষেত্রে সব ঠনঠন। আমাদের নেতৃবৃন্দ কিন্তু এ ক্ষেত্রে এক কাঠি ওপরে। নানা ঘটনার দিকে নজর দিলে আমাদের কথার সত্যতা মিলবে। কাল কী কথা বলবেন, হয়তো দিন মান তা ভেবেই গুজরান হয়। তাই কাজ করবেন কখন! তবে সুধী সমাজ ভাবেন, ‘কাজের কাজী’ তো আকাশ থেকে নেবে আসবে না। এখান থেকেই তাদের বেছে নিতে হবে। ওপরে যে কথা বলেছি, এখন তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই, সমাজে এখনো বহু সৎ যোগ্য মানুষের খুব একটা কমতি নেই, তারা সংগঠনের কাছে অকর্মাদের ভিড় ঠেলে আসবে না। সংগঠনকে তার সন্ধান করে নিতে হবে; তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া যাবে। সে পথে চলার এরাদা আমাদের রয়েছে।
আমাদের নেতাদের সংস্পর্শে এসে এখন সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠবেন, সে সুযোগ তো নেই। দেশের ওপর তলার মানুষের বহু অপকর্ম নিয়ে আমরা সবাই কিছু না কিছু জানি। নানা মিডিয়ায় তার বিস্তারিত সব কাহিনী আমরা শুনেছি ও পড়েছি। কিন্তু একেবারে তৃণমূলের শিক্ষাহীনতার অজ্ঞতা হোক বা পেটের দায়ে হোক বা আইনের প্রয়োগ না হওয়ার জন্য হোক তারা নিজের অজান্তেই মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করছে। দেশের কিছু মানুষ তার শিকার হচ্ছে। লক্ষ করলে দেখবেন, রাস্তাঘাটে মাইকিং করে সর্বরোগে মহৌষধ, ভাঙা হাড় জোড়া দেয়ার তেল, নানা চর্মরোগের ‘ম্যাজিক’ মলম বেচাকেনা চলছে। এসব দাওয়াই রোগ নিরাময় করে আর কতটা অপচিকিৎসা, ওষুধ প্রশাসন কি কখনো এসব ‘ওষুধ যাচাই-বাছাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে? অসচেতন ও নিম্ন আয়ের মানুষ ক্যানভাসারদের চটক বক্তৃতা শুনে এসব ‘ওষুধ’ ব্যবহার করেন। তারপর সে রোগীদের কী হয় না হয় তা কি কেউ কখনো জেনেছে? নিঃসন্দেহে এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই। এসব ‘ওষুধ’ ব্যবহার করে ভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। যারা এসব ‘ওষুধ’ বিক্রি করছে, তারা এককভাবে এ জন্য দায়ী নয়। রাষ্ট্র তো তাদের জন্য আয়-রোজগারের বিকল্প পথে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেনি। এসব ‘ওষুধ’ ক্ষতিকর সেটা তো তাদের বলা হয়নি বা বিকিকিনির ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করেনি কেউ। তবে দাঁড়াল কী? দেশের মানুষ কি ‘গিনিপিগ’, এর কোনো জবাব দেবে ওষুধ প্রশাসন? এ ছাড়া ভদ্রবেশী জোচ্চোরও আছে ওষুধের জগতে। সব নামীদামি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ওষুধের নকল ভেজাল তৈরি করে বাজারজাত করছে এ দুর্বৃত্তরা।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ফল কিনে খাওয়া কি সম্ভব? সাধারণ মানুষ তখনই ফল কিনে ঘরে যায়, যখন স্বজনদের কেউ অসুস্থ হয়ে ম্লান মুখে বিছানায় পড়ে থাকে। কিন্তু সেই কি পথ্য না কুপথ্য তা আমরা তো জানি না। আঙ্গুর, বেদানা, আপেল, নাশপাতিসহ সব ফলই বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু এসব ফল কি দেশে জন্মে? জবাব, না। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে এসব ফল আসছে। সে ফল আসার জন্য অনেক সময়ের দরকার। আর ফল তো দ্রুত পচনশীল পণ্য। কিন্তু আমাদের বাজারে যে ফল আমরা দেখি, তা দেখে তো মনে হয় এখন গাছ থেকে তা পেড়ে আনা হয়েছে। তাহলে এর রহস্য কী? রহস্যটা হচ্ছে এসব ফলে কয়েক দফা ‘প্রিজারভেটিভ’ দেয়া হয় পচন রোধের জন্য। সে কারণে এসব ফল এত তরতাজা মনে হয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ‘প্রিজারভেটিভ’ প্রয়োগ করা হলে তা হবে মানুষের জন্য স্লো ‘পয়জনিং’; তাহলে প্রশ্ন হলো আঙ্গুর বেদানা নাশপাতি আপেল খাওয়া যাবে না? যাবে, যদি তাতে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় প্রিজারভেটিভ দেয়া হয়। কিন্তু এসব ফলে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় প্রিজারভেটিভ দেয়া আছে কি না তা তো দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের কিন্তু তাদের মন এসব থেকে যদি অন্য দিকে পড়ে থাকে! কিছুকাল বাদে বহু মানুষ নানা সব মারাত্মক রোগে ভুগতে শুরু করবে। আমাদের সমাজে এমন বহু অসঙ্গতি বিরাজ করছে। তা বলে লিখে শেষ করা যাবে না।
মোদ্দা কথা শাসনব্যবস্থায় অনেক ব্যত্যয় রয়েছে। এসব বজায় রেখে দেশ এগিয়ে যাবে, সে তো অলীক কল্পনা; আলো নয় আলেয়া। দেশের জন্য সুস্থ সবল জনবল অপরিহার্য। সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্যোগ অব্যবস্থার শিকার হয়ে মানুষ যদি দুখী হতে থাকে, তবে তার পরিণতি শুভ হতে পারে না। মানুষ তো আনন্দ সুখ স্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তার ব্যত্যয় কেউ সইতে পারে না। এসব বিষয় পত্রিকায় তো আছে, দেশের সব আইনকানুন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ কোথায়? সমস্যাগুলোর একটা বিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু এ জন্য সঠিক পথ অনুসরণ করা হচ্ছে না। দেশে এসব ব্যবস্থা উদ্যোগ আয়োজন, আইনকানুন বিধিব্যবস্থা সবাই এখন ‘ডিপ ফ্রিজের’ ভেতর সংরক্ষিত রয়েছে। তা জমে কঠিন বরফ পিণ্ড হয়ে আছে। এর ফল গলবে কিভাবে!
Discussion about this post