স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই ধাপের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে৷ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্বাচনী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে৷
এসব সহিংসতার প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘ইউপি নির্বাচনে সবসময় একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে৷’’
বৃহস্পতিবার ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে সাত জনের৷ এর মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কুমিল্লায় দুইজন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন৷ এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটে মারা যান ছয়জন৷ এরপর থেকে ভোটের মাঠের প্রচারণায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আরও ২৪ জনের৷ সবমিলিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে৷
এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন অপ্রীতিকর ঘটনা ও সহিংসতা বন্ধে আপনি পুলিশকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা এমন একটা উদাহরণ দিতে পারবেন যে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল? পুলিশের কাজ পুলিশ করছে৷ আমাদের বিশাল এলাকা নিয়ে নির্বাচন হচ্ছে৷ এই ইউপি নির্বাচন এটা সবসময় আপনারা দেখে আসছেন, এটা গোষ্ঠী-গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন, এখানে সবসময়ই একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে৷ যেটা হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায় হতাহতের ঘটনা আমরা দেখছি৷ পুলিশ যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছে, দোষীদের ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে ফেলেছে৷ যারা এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে৷”
‘ঝগড়াঝাঁটি’ বিষয় জানতে চাইলে স্থনীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তারা এই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না৷ ৩৭ জনের মৃত্যুর পর এটা কিভাবে ঝগড়াঝাঁটি হয়৷ তার বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, মারামারি করে যে জিতে আসত পারবা সে আমার৷ আগামী নির্বাচনে তোমাকে আমার কাজে লাগবে৷’’ কেন এই সহিংসতা জানতে চাইলে ড. আহমেদ বলেন, ‘‘এটা তো নির্বাচনী সহিংসতা না, এটা ক্ষমতা দখলের সহিংসতা৷ এখানে যে নির্বাচিত হতে পারবে, সে তত বেশি লুটপাট করতে পারবে৷ এখন নির্বাচন করছে কারা? এদের লুটপাটের না হয় জবরদখলের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে৷ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্যই তো তাদের নির্বাচিত হওয়া দরকার৷”
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ‘ঝগড়াঝাঁটি’তে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাহুরখলা ইউনিয়নের হিরারচর গ্রামের মৃত মুদাফর আলীর ছেলে সানাউল্লাহ ডালি (৬০) ও মানিকচর ইউনিয়নের বল্লবেরকান্দি গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে শাওন আহমেদ (২৫) মারা গেছেন৷ মানিকরচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাহুরখলা ইউনিয়নের খিলারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু হয়৷
নরসিংদীর রায়পুরায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে তিন জন মারা গেছেন৷ নিহতরা হলেন, বাঁশগাড়ি এলাকার দুলাল মিয়া (৪৫), সালাউদ্দিন (৪১) ও জাহাঙ্গীর মিয়া (২৬)৷ বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছে আশরাফুল হক সরকার৷ দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন নির্বাচন করছেন মোবাইল ফোন প্রতীক নিয়ে৷ নির্বাচন ঘিরে এই দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এই তিনজনের মৃত্যু হয়৷
এছাড়া কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকূল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷ সাধারণ সদস্য প্রার্থী আনোয়ারা বেগম ও আবু বক্কর সিদ্দীকের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে আক্তারুজ্জামান পুতু (৩২) মারা যান৷ দুই প্রার্থীই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে৷ চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতেও দুই ইউপি মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মোহাম্মদ শফি (৫৫) নামে একজন নিহত হয়েছেন৷ দুই সদস্য প্রার্থীই আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন৷
অভ্যন্তরীণ বিবাদে কেন এই প্রাণক্ষয়? জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে নির্বাচিত হতে পারলে তো নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা, লুটপাটের ভাগিদার হওয়া যাবে৷ ফলে তারা সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ এখানে আধিপত্যের লড়াইয়ে যে টিকে থাকতে পারবে সেই সুবিধাগুলো পাবে৷ ফলে এটাকে ভোটের সহিংসতা না বলে আধিপত্যের লড়াইয়ের সহিংসতা বলাই ভালো৷ আর নির্বাচন কমিশন তো নিজেদের অবস্থান আগেই নষ্ট করে ফেলেছে৷ এই ধরনের সহিংসতা বন্ধে তাদের কোন ধরনের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না৷ তাদের কেউ মাঠেও নেই৷”
তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতী’র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এলে তখনও হয়তো এই ধরনের সহিংসতা হতে পারত৷ কিন্তু এত সহিংসতা আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেখিনি৷ কিন্তু এখানে যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয় যে, যারা ভোটের মাঠে সহিংসতা করছে তারা আগে মাঠ থেকে বিরোধীদের হটিয়ে দিয়েছে৷ ফাঁকা মাঠে তারা এখন নিজেরাই ভীষণ অসহিষ্ণু ও উগ্র হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে৷ এই পরিস্থিতি এখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটাই এখন আমার প্রশ্ন?’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে
Discussion about this post