অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সাফল্য আছে। ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক। কিন্তু উল্টো ঘটনা দেখা যাচ্ছে টিকার ক্ষেত্রে। সাতটি টিকা তৈরির অভিজ্ঞতা থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন কোনো টিকা তৈরি করে না। এমনকি মহামারিতেও এসেও শিক্ষা নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান পঙ্গু করে ফেলেছে ক্ষমতাসিনরা। ভ্যাক্সিন উৎপাদনের শুরু থেকে পরমর্শ দিয়ে আসলেও সরকার পাত্তা দেয়নি। সরকারের অবহেলার কারনেই আজ টিকা তৈরীতে সাহস দেখাতে পারিনি বাংলাদেশ। শুধু সরকার উদ্যোগ নিলেই টিকার এই সংকট থেকে মুক্ত পেতো দেশ। গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলার ভোগান্তি এখন পাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক বলেন, ‘একসময় বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানটিকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে অবহেলার চোখে দেখেছে। করোনা মহামারির এই সময় এসে দেখা যাচ্ছে, টিকা উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের থাকা কত জরুরি।’
করোনার টিকা পাওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনা টিকা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, টিকা উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বাংলাদেশ সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কিনছে।
এই সেরাম ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা ২০০৭ সালে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আধুনিক কারখানা তৈরির পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই পরামর্শ কাগজেই আছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি খাদ্যমান পরীক্ষা, গবেষণাগারের মান নির্ধারণ, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণসহ গবেষণার কাজে যুক্ত।
ছিল গৌরবময় ঐতিহ্য
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সরকারের ঢাকা জেলা গেজেটিয়ারে বলা আছে, ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দুটি শাখায় দুই ধরনের টিকা তৈরি হতো। একটি শাখায় কলেরা ও টাইফয়েড, অন্য শাখায় গুটিবসন্ত ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা তৈরি হতো। প্রতিটি শাখার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ছিল বছরে ৫ থেকে ৭ কোটি ডোজ টিকা।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া কাগজপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৫৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানে গুটিবসন্তের টিকা উৎপাদন শুরু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ১৯৭৮ সালে গুটিবসন্তের টিকা উৎপাদন বন্ধ করে এই প্রতিষ্ঠান। এর দুই বছর পর ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। গুটিবসন্তের সর্বশেষ সংক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৯৭৭ সালে, আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায়।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় বছর আগে অবসর নিয়েছেন অণুজীববিজ্ঞানী ড. সেতারুন নাহার। তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি গুটিবসন্তের টিকা বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান), ভারত ও পাকিস্তানে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশ্বের এই অঞ্চলে গুটিবসন্ত নির্মূলে এই প্রতিষ্ঠানের বড় ভূমিকা ছিল।’
প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৫৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানে আরও তিনটি টিকা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। সেগুলো ছিল কলেরার টিকা, টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের টিকা এবং কলেরা-টাইফয়েডের টিকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ১৯৯৭ সালে এই তিনটি টিকা উৎপাদনও বন্ধ করে প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে নতুন প্রযুক্তি আসার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এই প্রতিষ্ঠানে জলাতঙ্ক রোগের টিকা উৎপাদন শুরু হয়। উৎপাদন চলে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৮ সালে টিটেনাসের টিকা উৎপাদন শুরু করে ২০০৪ সালে পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। ১৯৭৮ সালে ডিপথেরিয়ার টিকাও তৈরি হয়েছিল। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) এর চাহিদা না থাকায় ১৯৮৭ সালে ডিপথেরিয়ার টিকা উৎপাদন বন্ধ করে দেয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। একসময় এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত টিকা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো।
১৯৭৮ সালে ইপিআই শুরু হলে ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশে টিকা আনা শুরু হয়। বাংলাদেশে ডিপিটির টিকা আসত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। এই কারণে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ড. সেতারুন নাহার বলেন, ২০০৬-০৭ সালে সেরাম ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের সভা হয়। সেরামের বিশেষজ্ঞরা একটি আধুনিক টিকা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার রূপরেখা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তা নিয়ে কাজ আর এগোয়নি।
অদূরদর্শিতা ও ক্ষমতাসীনদের অবহেলা
বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান কেন টিকা উৎপাদন বন্ধ করে দিল, তা নিয়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এবং ওষুধবিজ্ঞানীরা একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হওয়ার পর এই টিকা উৎপাদন করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে নতুন নতুন প্রযুক্তিতে টিকা উৎপাদন শুরু হওয়ায় জলাতঙ্কসহসহ অন্যান্য টিকা উৎপাদন বন্ধে পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি দেশে আনার কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
সরকারের কাগজপত্র বলছে, মহাখালীতে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমির পরিমাণ ৪৭ দশমিক ৮ একর। প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মুজাহেরুল হক বলেন, বিপুল পরিমাণ জমি হাতছাড়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রেও অবহেলা আছে। দুই দশক ধরে দেখা গেছে, কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের এখানে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে অণুজীববিজ্ঞানী বা ওষুধবিজ্ঞানীর পদে অন্য বিষয়ের লোকদের পদায়ন করা হয়।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post