অপরাধ সভ্যতার অবদান। যখন সভ্যতা আসেনি তখন অপরাধও ছিল না। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের কিছু কাজ অপরাধ হিসাবে চিহ্নিতকরণ এবং তা প্রতিবিধানের জন্য আইন-আদালতের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত সুশাসনের ধারণা থেকেই অপরাধের সংজ্ঞা এবং অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইন-আদালতের সূচনা। কিন্তু আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রণীত আইনগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে সুশাসনের নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে না বরং সেগুলো নিবর্তনের জন্যই প্রণীত হচ্ছে। দেশের এমনই একটি আইন হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আইনটি জনস্বার্থে প্রণীত বলে দাবি করা হলেও তা এখন গণনিবর্তনের অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি এই আইনে আটক ও দীর্ঘ কারাভোগকালে অনাকাক্সিক্ষতভাবে লেখক মোস্তাক আহমেদের মৃত্যু সে অভিযোগকে আরও মজবুত করেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারাবন্দী অবস্থায় লেখকের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জোর দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করে তথাকথিত প্রভাবশালীগোষ্ঠীর হাতে ভিন্নমত দমনের মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকলে এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও ব্যক্তিকে দায়বদ্ধতার আওতায় আনা দরকার বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত যেসব ধারায় মুশতাকসহ অনেকের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবার অভিপ্রায়ে অপপ্রচারের’ যে সব অভিযোগের কথা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তিবিশেষে তার অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যার একটি ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে টিআইবির পক্ষে বলা হয়েছে, ‘একই মামলায় অন্য অভিযুক্তরা জামিন পেলেও ছয়বার আবেদন করা সত্ত্বেও মুশতাক আহমেদের জামিন না হওয়া নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার নামে দিনের-পর-দিন জেলখানায় আটকে রাখা এবং রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুকে সরকার আর আট-দশটি ঘটনার মতোই বিবেচনা করছে। এক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ব্যক্তিবিশেষ দুরভিসন্ধিমূলকভাবে অপব্যবহার করছে কী-না এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর মিলছে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ৪৫৭ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে ১৯৭টি মামলা হয়েছে, যেখানে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আইনের করা মামলার অধিকাংশেরই বাদী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়তো ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। মূলত, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বিরোধীমত ও সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতেই কার্যত ব্যবহৃত হচ্ছে।
জনকল্যাণমূলক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রসর, পূর্বশর্ত সমালোচনানির্ভর জবাবদিহিতা। ‘সমালোচক’ মাত্রই শত্রু নয়; বরং শুভাকাক্সক্ষী হতে পারেন, ইতিবাচক অর্জনের অনুঘটকও হতে পারেন উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, ‘সরকারের সমালোচনা করা নাগরিকের অধিকার, তথা মতপ্রকাশের অধিকার কোনো সভ্য সমাজে অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে না। একইসাথে, রাষ্ট্র ও সরকার যে দুটি ভিন্নসত্তা তাও একাকার করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের দুর্নীতি এবং অনৈতিক ও অন্যায় কাজের সমালোচনা করতে ব্যক্তি যে বাকস্বাধীনতার চর্চা করেন, তা কোনোঅর্থেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে না। সমালোচনাকারী মূলত দেশের ও দশের কল্যাণে একটি কার্যকর জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চায়। এই সত্যটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে সরকারের সৎসাহসের অভাবের পাশাপাশি ইচ্ছাশক্তিও তিরোহিত হয়েছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ মুশতাক আহমেদের মৃত্যু।’
মূলত সুশাসন নিশ্চিতের ধারণা থেকেই আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। তাই যেকোন আইনই প্রণীত হতে হবে জনস্বার্থের অনুকূলে। জননিবর্তনমূলক কোন আইন আইনী মর্যাদা পেতে পারে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।
Discussion about this post