বুলবুল আহমেদ
দেশব্যাপী ধর্ষণের মহামারি ও ধর্ষণরোধে কঠোর আইন পাশ হওয়ার প্রেক্ষিতে একটি ধর্মবিদ্বেষী মহল উঠে পড়ে লেগেছে স্বামীর ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ককে জোরজবরদস্তি বা ধর্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এর দাবিতে লিগ্যাল নোটিশ দেয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা কোনো কথা বলছেন না, এর প্রতিবাদও করছেন না। অথচ এটি মারাত্মকভাবে একটি ইসলামীবিদ্বেষী ও সমাজবিধ্বংসী ব্যাপার। আসুন শুরুতেই জানার চেষ্টা করি ইসলামে বিবাহের স্বরূপ কী, এবং কেন বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কিছু নেই।
বাংলা বিবাহ বা বিয়ের আরবি পরিভাষা হল নিকাহ। আরবিতে এই নিকাহ শব্দের একাধিক সমার্থক শব্দ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল যৌন সম্ভোগ।
বিবাহ বা নিকাহ এর সংজ্ঞায় বহুল পঠিত ফিকহবিষয়ক গ্রন্থ “শরহে বেকায়া”র প্রণেতা প্রখ্যাত ফিকহবিদ উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রহ:) বলেন:
هو عقد موضوع لملك المتعة
অর্থাৎ বিবাহ এমন একটি عقد (আক্বদ) বা চুক্তি যা ملك المتعة (মিলকিল মুতআহ) বা উপভোগের মালিকানা প্রদানের জন্য গঠিত। সহজ কথায় বিয়ে এমন একটা পারস্পরিক চুক্তি যার মাধ্যমে একজন পুরুষের পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদে নারীর থেকে উপভোগের অধিকার পাশাপাশি নারীর জন্য পুরুষের পক্ষ থেকে ভরণপোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই চুক্তির প্রথম পক্ষ হচ্ছে পুরুষ বা স্বামী যিনি মূলত তার যৌন সম্পর্কের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকে প্রস্তাব দেয় এবং এর জন্য বিনিময় বা মূল্য হিসেবে মহর প্রদান করে।
বিবাহের ভিত্তি বা রোকন হল দুটি:
১. ইজাব (প্রস্তাব) ও
২. কবুল (সম্মতি)
যেহেতু বিয়েতে পুরুষের পক্ষ থেকে নারীকে ইজাব বা প্রস্তাব করার পর নারীর পক্ষ থেকে কবুল বলা হয় সেসময়ই নারীর উপর পুরুষের যৌন সম্পর্কের স্থায়ী সম্মতি আদায় হয়। এর প্রমাণ হিসেবে শুধু একা নারী নয় নারীর অভিভাবক ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাক্ষীও রাখা হয় বিবাহে।
তাই বিয়ের পরে নতুন করে প্রতিবার যৌন সংসর্গের ক্ষেত্রে নারীর অনুমতি নিতে হবে এটা ভ্রান্ত ও মুর্খতাপ্রসূত বক্তব্য। বিবাহে কবুল বলা বা সম্মতি প্রদানের পর একান্ত শারীরিক সমস্যা ছাড়া পুরুষের যৌন সম্পর্কের আগ্রহে সাড়া না দেয়ার সুযোগ থাকে না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী পুরুষ এক্ষেত্রে স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারে। পুরুষরা যে সবসময় বাধ্য করে এমনটাও না। এটা মূলত পারস্পরিকভাবেই ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে গুরুতর কারণ ছাড়া স্ত্রী সম্মত না হলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী পুরুষেরই বরং মামলা করার অধিকার আছে। স্ত্রী যদি তার স্বামীর এই চাওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে আসলে তাদের মাঝে আর বিয়েই বহাল থাকে না।
কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করলেও বিবাহ বহাল থাকা অবস্থায় মামলা করার কোনো আইনগত, ধর্মীয় বা যৌক্তিক অধিকার স্ত্রীর নেই। হ্যাঁ স্বামী ভরণপোষণ না দিলে, নারীর উপর নির্যাতন চালালে নির্দিষ্টভাবে সেই নির্যাতনের বিচার স্ত্রী আদালতে চাইতে পারে। যদি তার স্বামীকে আর প্রয়োজন না হয় বা উক্ত স্বামীর সংসার করার ইচ্ছা না থাকে সে আইনগতভাবে বিচ্ছেদও চাইতে পারে। এমনকি বিয়ের সময় যথোপযুক্ত মোহর পরিশোধ করা না হলেও আপত্তি করতে পারে, সে অধিকার ইসলাম নারীকে দিয়েছে।
কাজেই বৈবাহিক ধর্ষণ কথাটি আসলে ইসলামবিদ্বেষীদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও মুর্খতারই বহিঃপ্রকাশ। অথবা এটি হতে পারে ইসলাম, ইসলামী বিধান, আইন ও অনুশাসনের বিরুদ্ধে তাদের চিরন্তন ষড়যন্ত্রের অংশ।
স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা ও সমঝোতা ছাড়া কোনো সংসার টিকে থাকতে পারে না। কোরআনের ভাষায় নারীরা পুরুষের পোশাক পুরুষরাও নারীদের পোশাক (সুরা বাকারা ১৮৭ )। স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের সম্পর্ক দাবি ও গোপনীয়তার পরিপূরক। এই পারিবারিক বোঝাপড়া ও পরষ্পরের আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার প্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত। এতে বাইরে থেকে ইসলামবিদ্বেষীদের নাক গলানোর কোনো প্রয়োজনই নেই।
এই ইসলামবিদ্বেষীরা আসলে চায় সমাজ থেকে বিবাহ বিলুপ্ত হোক। মুসলিমদের পারিবারিক বন্ধন ধ্বংস হোক, ব্যভিচার বা লিভ টুগেদার প্রসার লাভ করুক। তারা চায় নানামুখী আইনের বেড়াজালে ভয় পেয়ে যুবসমাজ বিয়ের বদলে পশ্চিমাদের আদলে ব্যভিচার ও সমকামিতায় বাধ্য হোক। যা হতে দেয়া মুসলিম জনগোষ্ঠির কোনোভাবেই উচিৎ নয়।
মুসলিমদের সময় থাকতে এই ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এগিয়ে আসা উচিৎ। আলেমদের উচিৎ ইসলামের বিধান সুষ্পষ্টভাবে সহজ ভাষায় মানুষের জন্য তুলে ধরা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুবুদ্ধি ও হেদায়াত দান করুন।
তথ্যসূত্র:
১. শরহে বেকায়া ২য় খণ্ড, মূল: উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রহ:), বাংলা: হাফেয মাওলানা মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, বাবুন নিকাহ (বিবাহ অধ্যায়), পৃষ্ঠা ২৮।
২. https://www.pathagar.com/book/detail/2514
৩. https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&ID=2001&bk_no=27&flag=1
লেখক: ইসলামী গবেষক ও ব্লগার