ফিরোজ মাহবুব কামাল
অর্জিত পরাধীনতা
একাত্তরের পর বাংলাদেশের ভূমি, সম্পদ ও জনগণ যে কতটা অরক্ষিত সেটি বুঝতে কি প্রমানের প্রয়োজন পড়ে? ২৩ বছরের পাকিস্তান আমলে যে দাবীগুলো ভারতীয় নেতাগণ মুখে আনতে সাহস পায়নি সেগুলি এখন মুজিবামলে আদায় করে ছেড়েছ। পাকিস্তান আমলে তারা বেরুবাড়ির দাবী করেনি, কিন্তু একাত্তরে শুধু দাবিই করেনি, ছিনিয়েও নিয়েছে। এবং সেটি মুজিবের হাত দিয়ে। প্রতিদানে কথা ছিল তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দিবে। কিন্তু সেটি দিতে ৪০ বছরের বেশীকাল যাবত টালবাহানা করেছে। টালবাহানা করেছে আঙরপোতা, দহগ্রামের ন্যায় বহু বাংলাদেশী ছিটমহল দিতে। ভারত সেগুলিতে যাওয়ার করিডোর দিতে গড়িমসি করলে কি হবে, এখন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর আদায় করে নিল। সেটি নিল প্রতিবেশীর প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতার দোহাই দিয়ে। অথচ এমন সহযোগিতা কোন কালেই ভারত প্রতিবেশীকে দেয়নি।
ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার তার পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগের স্বার্থে করিডোর চেয়েছিল। সেটিকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়ারলাল নেহেরু একটি অদ্ভুদ দেশের অদ্ভুত আব্দার বলে মস্করা করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের নিরাপত্তার প্রতি এমন ট্রানজিট হবে মারাত্মক হুমকি। শুধু তাই নয়, একাত্তরে ভারতীয় ভূমির উপর দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের পিআইয়ের বেসামরিক বাণিজ্য বিমান উড়তে দেয়নি। এমন কি শ্রীলংকার উপর চাপ দিয়েছিল যাতে পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানকে কোন জ্বালানী তেল না দেয়। বাংলাদেশের সাথেই কি আচরন ভিন্নতর? একাত্তরের যুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। ফলে গুরুতর ব্যাঘাত ঘটছিল বন্দরে মালামাল বোঝাই ও উত্তোলনের কাজে। এতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি প্রচন্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। দেশে তখন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। ছিল নিতান্তই দুঃসময়। বাংলাদেশের জন্য চট্রগ্রাম বন্দরটিই ছিল মূল বন্দর। এমন দুঃসময়ে অন্য কেউ নয়, ভারতের অতি বন্ধুভাজন শেখ মুজিব অনুমতি চেয়েছিলেন অন্ততঃ ৬ মাসের জন্য কোলকাতার বন্দর ব্যবহারের। তখন ভারত সরকার জবাবে বলেছিল ৬ মাস কেন ৬ ঘন্টার জন্যও বাংলাদেশকে এ সুবিধা দেয়া যাবে না। এটিকেও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেছিল। প্রতিবেশী সুলভ সহযোগিতার বুলি তখন নর্দমায় স্থান পেয়েছিল। এমনকি শেখ মুজিবকেও ভারত আজ্ঞাবহ এক সেবাদাস ভৃত্যের চেয়ে বেশী কিছু ভাবেনি। ভৃত্যকে দিয়ে ইচ্ছামত কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু তার আব্দারও কি মেনে নেওয়া যায়? এসবই হলো একাত্তরের অর্জন। এভাবে বেড়েছে পরাধীনতা, স্বাধীনতা নয়।
প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের এরূপ বৈরী আচরন নিত্যদিনের। প্রতিবেশী নেপাল ও ভূটানের সাথে বাণিজ্য চলাচল সহজতর করার জন্য ১৭ কিলোমিটারের ট্রানজিট চেয়েছিল বাংলাদেশ। নেপাল চেয়েছিল মংলা বন্দর ব্যবহারের লক্ষ্যে ভারতের উপর দিয়ে মালবাহি ট্রাক চলাচলের ট্রানজিট। ভারত সে দাবি মানেনি। অথচ সে ভারতই নিল বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রায় ছয় শত মাইলের করিডোর। ফলে বুঝতে কি বাঁকি থাকে, পারস্পারিক সহযোগিতা বলতে ভারত যেটি বুঝে সেটি হলো যে কোন প্রকারে নিজের সুবিধা আদায়। প্রতিবেশীর সুবিধাদান নয়। কথা হলো, বাংলাদেশের জন্য ১৭ কিলোমিটারের ট্রানজিট যদি ভারতের জন্য নিরাপত্তা-সংকট সৃষ্টি করে তবে সে যুক্তি তো বাংলাদেশের জন্যও খাটে। তাছাড়া বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ভারতের সৃষ্ট ষড়যন্ত্র নতুন নয়। ১৯৭৫ সালে মুজিব নিহত হওয়ার পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্ব কিছু আওয়ামী লীগ ক্যাডার ভারতে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের সীমান্তে তারা সন্ত্রাসী হামলাও শুরু করে। তাদের হামলায় বহু বাংলাদেশী নিরীহ নাগরিক নিহতও হয়। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থাগুলি তাদেরকে যে শুধু অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে তাই নয়, নিজ ভূমিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহারেরও পূর্ণ সুযোগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের টিকেট পিরোজপুর থেকে দুই-দুইবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতার ভারতে গিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন গড়ে তুলেছে সত্তরের দশক থেকেই। ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত এসব সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া দূরে থাক তাদেরকে নিজভূমি ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ দিয়েছে। এসব কি প্রতিবেশী-সুলভ আচরণ? অথচ সে ভারতই দাবি তুলেছে আসামের উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার। হাসিনা সরকার তাদেরকে ভারতের হাতে তুলেও দিচ্ছে। অথচ কাদের সিদ্দিকী ও চিত্তরঞ্জন সুতারের ন্যায় উলফা নেতাদের ভাগ্যে বাংলাদেশের মাটিতে জামাই আদর জুটেনি। ঘাঁটি নির্মান, সামরিক প্রশিক্ষণ ও বাংলাদেশের ভূমি থেকে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনার সুযোগও জুটেনি। বরং জুটেছে জেল।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ভারতীয় ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের করিডোর যে কতটা আত্মঘাতি এবং কিভাবে সেটি বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করবে -সে বিষয়টিও ভাববার বিষয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত জুড়ে মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুনাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম -ভারতের এ সাতটি প্রদেশ। এ রাজ্যগুলির জন্য এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট রয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
এক.
সমগ্র এলাকার আয়তন বাংলাদেশের চেয়েও বৃহৎ অথচ অতি জনবিরল।
দুই.
সমগ্র এলাকাটিতে হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ট। ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ নিয়ে সমগ্র উপমহদেশে যে রাজনৈতিক সংঘাত ও উত্তাপ -এ এলাকায় সেটি নেই। ফলে এখানে বাংলাদেশ পেতে পারে বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী যা তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্ঠিত বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব -এ দুই দিকের সীমান্ত অতি সহজেই নিরাপত্তা পেতে পারে এ এলাকায় বন্ধু সুলভ কোন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে। অপরদিকে নিরাপত্তা চরম ভাবে বিঘ্নিত হতে পারে যদি কোন কারণে তাদের সাথে বৈরীতা সৃষ্টি হয়। তাই এ এলাকার রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রাখাটি বাংলাদেশের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান যেমন আফগানিস্তানের রাজনীতি থেকে হাত গুটাতে পারে না, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় এ বিশাল এলাকার রাজনীতি থেকে দূরে থাকা। যেহেতু এ এলাকায় চলছে প্রকাণ্ড এক জনযুদ্ধ তাই তাদের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করা হবে আত্মঘাতি। অথচ ভারত চায়, বাংলাদেশকে তাদের বিরুদ্ধে খাড়া করতে।
তিন.
একমাত্র ব্রিটিশ আমল ছাড়া এলাকাটি কখনই ভারতের অন্তর্ভূক্ত ছিল না, এমনকি প্রতাপশালী মুঘল আমলেও নয়। হিন্দু আমলে তো নয়ই। মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন বাংলার সুবেদার তথা গভর্নর, তখন তিনি একবার আসাম দখলের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সে দখলদারি বেশী দিন টিকিনি। আসামসহ ৭টি প্রদেশের ভূমি ভারতভূক্ত হয় ব্রিটিশ আমলের একেবারে শেষ দিকে। ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া সেজন্যই এখানে ততটা সফলতা পায়নি। এবং গণভিত্তি পায়নি ভারতপন্থি রাজনৈতিক দলগুলি।
চার.
সমগ্র এলাকাটি শিল্পে অনুন্নত এবং নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। অথচ এলাকাটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ভারতের সিংহভাগ তেল, চা, টিম্বার এ এলাকাতে উৎপন্ন হয়। অথচ চা ও তেল কোম্মানীগুলোর হেড-অফিসগুলো কোলকাতায়। কাঁচামালের রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলিও এলাকার বাইরের। ফলে রাজস্ব আয় থেকে এ এলাকার রাজ্যগুলি বঞ্চিত হচ্ছে শুরু থেকেই। শিল্পোন্নত রাজ্য ও শহরগুলো অনেক দূরে হওয়ায় পণ্যপরিহন ব্যয়ও অধিক। ফলে সহজে ও সস্তায় পণ্য পেতে পারে একমাত্র উৎস বাংলাদেশ থেকেই। ভারতকে করিডোর দিলে সে বাণিজ্যিক সুযোগ হাতছাড়া হতে বাধ্য।
পাঁচ.
যুদ্ধাবস্থায় অতি গুরুত্বপূর্ণ হল নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্ত এ এলাকায় সে সুযোগ ভারতের নেই। ভারতের সাথে এ এলাকার সংযোগের একমাত্র পথ হল পার্বত্যভূমি ও বৈরী জনবসতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্য অবস্থিত ১৭ কিলোমিটার চওড়া করিডোর। এ করিডোরে স্থাপিত রেল ও সড়ক পথের কোনটাই নিরাপদ নয়। ইতিমধ্যে গেরিলা হামলায় শত শত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির সেখানে প্রাণনাশ হয়েছে।
ছয়.
নৃতাত্বিক দিক দিকে এ এলাকার মানুষ মাঙ্গোলিয়। ফলে মূল ভারতের অন্য যে কোন শহরে বা প্রদেশে পা রাখলেই একজন নাগা, মিজো বা মনিপুরি চিহ্নিত হয় বিদেশী রূপে। তারা যে ভারতী নয় সেটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এ ভিন্নতাই যথেষ্ট। এ ভিন্নতার জন্যই সেখানে স্বাধীন হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলছে বিগত প্রায় ৭০ বছর ধরে। ভারতীয় বাহিনীর অবিরাম রক্ত ঝরছে এলাকায়। বহু চুক্তি, বহু সমঝোতা, বহু নির্বাচন হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার সে যুদ্ধ থামেনি। ফলে বাড়ছে ভারতের অর্থনীতির উপর চাপ। সমগ্র এলাকা হয়ে পড়েছে ভারতের জন্য ভিয়েতনাম। যে কোন সময় অবস্থা আরো গুরতর রূপ নিতে পারে। আফগানিস্থানে একই রূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল রাশিয়ার জন্য। সে অর্থনৈতিক রক্তশূণ্যতার কারনে বিশাল দেহী রাশিয়ার মানচিত্র ভেঙ্গে বহু রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ভারত রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী নয়। তেমনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে এ এলাকার মানুষের অঙ্গিকার, আত্মত্যাগ এবং ক্ষমতাও নগণ্য নয়। ফলে এ সংঘাত থামার নয়। ভারত চায় এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু ভারতের কাছে সংকট মুক্তির সে রাস্তা খুব একটা খোলা নাই।
ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোর নিয়েছে পণ্য-পরিবহন ও আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দোহাই দিয়ে। বিষয়টি কি আসলেই তাই? মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুনাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের সমুদয় জনসংখ্যা ঢাকা জেলার জনসংখ্যার চেয়েও কম। এমন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির জন্য পণ্যসরবরাহ বা লোক-চলাচলের জন্য এত কি প্রয়োজন পড়লো যে তার জন্য অন্য একটি প্রতিবেশী দেশের মধ্য দিয়ে করিডোর চাইতে হবে? সেখানে এক বিলিয়ন ডলার বিণিয়োগ করতে হবে? যখন তাদের নিজের দেশের মধ্য দিয়েই ১৭ কিলোমিটারের প্রশস্ত করিডোর রয়েছে। বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলো দেশের আভ্যন্তরীণ সড়কের দুরবস্থার কথা জানিয়ে এতকাল পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে। এবার ভারত বলছে তারা সড়কের উন্নয়নে বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার লোন দিতে রাজী। এবার বাংলাদেশ যাবে কোথায়? অথচ এই এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে ভারত তার ১৭ মাইল প্রশস্ত করিডোর দিয়ে একটি নয়, ডজনের বেশী রেল ও সড়ক পথ নির্মাণ করতে পারতো। এলাকায় নির্মিত হতে পারতো বহু বিমান বন্দর। ভারতের সে দিকে খেয়াল নাই, দাবী তুলেছে বাংলাদেশের মাঝ খান দিয়ে যাওয়ার পথ চাই-ই। যেন কর্তার তোগলোকি আব্দার। গ্রামের রাস্তা ঘুরে যাওয়ায় রুচি নেই, অন্যের শোবার ঘরের ভিতর দিয়ে যেতেই হবে। গ্রামের ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তায় পথ চলতে অত্যাচারি কর্তার ভয় হয়। কারণ তার কুর্মের কারণে শত্রুদের সংখ্যাটি বিশাল। না জানি কখন কে হামলা করে বসে। একই ভয় চেপে বসেছে ভারতীয়দের মাথায়। সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে তারা চিহ্নিত হয়েছে উপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রূপে। তারা চায় ভারতীয় শাসন থেকে আশু মুক্তি। এ লক্ষে জানবাজি রেখে তারা যুদ্ধে নেমেছে। ফলে ভারতের জন্য অবস্থা অতি বেগতিক হয়ে পড়েছে। একদিকে কাশ্মীরের মুক্তিযুদ্ধ দমনে যেমন ছয় লাখেরও বেশী ভারতীয় সৈন্য অন্তহীন এক যুদ্ধে আটকা পড়েছে, তেমনি তিন লাখের বেশী সৈন্য যুদ্ধে লিপ্ত উত্তর-পূর্ব এ ভারতে। যুদ্ধাবস্থায় অতিগুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। ফলে যতই এ যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে ততই প্রয়োজন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোরের। তাই করিডোর নেয়া হলো যে নিতান্তই সামরিক প্রয়োজনে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? আর বাংলাদেশের জন্য শংকার কারণ মূলতঃ এখানেই। ভারত তার চলমান রক্তাত্ব যুদ্ধে বাংলাদেশকেও জড়াতে চায়। এবং সে সাথে কিছু গুরুতর দায়িত্বও চাপাতে চায়। কারো ঘরের মধ্য দিয়ে পথ চললে সে পথে কিছু ঘটলো সহজেই সেটির দায়-দায়িত্ব ঘরের মালিকের ঘাড়ে চাপানো যায়। তার বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলাও দায়ের করা যায়। কিন্তু বিজন মাঠ বা ঝোপঝাড়ের পাশে সেটি ঘটলে আসামী খুঁজে পাওয়া দায়। ভারত এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫ শত মাইলের করিডোর এবং সে করিডোরের নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের কাঁধে চাপাতে চায়। এ পথে ভারতীয়দের উপর হামলা হলে বাংলাদেশকে সহজেই একটি ব্যর্থ দেশ এবং সে সাথে সন্ত্রাসী দেশ রূপে আখ্যায়ীত করে আন্তর্জাতিক মহলে নাস্তানাবুদ করা যাবে। সে সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত বলার বাহানাও পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের জন্য এখানেই বিপদ।
যে হামলা অনিবার্য
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ভারতীয় যানবাহন চলা শুরু হলে সেগুলির উপর হামলার সম্ভাবনা কি কম? ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর নিষ্ঠুর বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ ৭০ বছর যাবত। এক লাখের বেশী কাশ্মীরীকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, বহু হাজার মুসলিম নারী হয়েছে ধর্ষিতা। এখনও সে হত্যাকান্ড ও ধর্ষণ চলছে অবিরাম ভাবে। জাতিসংঘের কাছে ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে ওয়াদা করেছিল কাশ্মীরীদের ভাগ্য নির্ধারণে সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দিবে। জাতিসংঘের নিরাপত্ত পরিষদ এ্যাডমিরাল নিমিটস্ এর উপর দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভারত সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। এবং সেটি নিছক গায়ের জোরে। এভাবে কাশ্মীরীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের পথে। অপর দিকে ভারত জুড়ে মুসলিমদের হত্যা, মুসলিম নারীদের ধর্ষণ, তাদের ঘরবাড়ীতে আগুণ, এমনকি মসজিদ ভাঙ্গার কাজ হয় অতি ধুমধামে ও উৎসবভরে। অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার কাজ হয়েছে হাজার পুলিশের সামনে দিন-দুপুরে। হাজার হাজার সন্ত্রাসী হিন্দুদের দ্বারা ঐতিহাসিক এ মসজিদটি যখন নিশ্চিহ্ন হচ্ছিল তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও, বিরোধী দলীয় নেতা বাজপেয়ী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ সম্ভবতঃ আনন্দভরে ডুগডুগি বাজাচ্ছিলেন। এটি ছিল বড় মাপের একটি ঐতিহাসিক অপরাধ। অথচ এ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর ভারত সরকারের কোন পুলিশ কোন অপরাধীকেই গ্রেফতার করেনি। আদালতে কারো কোন জেল-জরিমানাও হয়নি। ভাবটা যেন, সেদেশে কোন অপরাধই ঘটেনি। মসজিদটি যেন নিজে নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভারতীয়দের মানবতাবোধ ও মূল্যবোধের এটিই প্রকৃত অবস্থা। এমন একটি দেশ থেকে কি সুস্থ্য পররাষ্টনীতি আশা করা যায়? দেশটিতে দাঙ্গার নামে হাজার হাজার মুসলমানকে জ্বালিয়ে মারার উৎসব হয় বার বার। সাম্প্রতিক কালে আহমেদাবাদে যে মুসলিম গণহত্যা হল সংখ্যালঘূদের বিরুদ্ধে তেমন কান্ড পাকিস্তানের ৭০ বছরের জীবনে একবারও হয়নি। বাংলাদেশের ৫০ বছরের জীবনেও হয়নি।
কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আযাদ লিখেছিলেন, ‘‘আফ্রিকার কোন জঙ্গলে কোন মুসলমান সৈনিকের পায়ে যদি কাঁটাবিদ্ধ হয় এবং সে কাঁটার ব্যাথা যদি তুমি হৃদয়ে অনুভব না কর -তবে খোদার কসম তুমি মুসলমান নও।” –(সুত্রঃ মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রচনাবলী, প্রকাশক: ইসলামী ফাউন্ডেশন, ঢাকা)। এমন চেতনা মাওলানা আবুল কালাম আযাদের একার নয়, এটিই ইসলামের বিশ্ব-ভাতৃত্বের মৌলিক কথা। যার মধ্যে এ চেতনা নাই তার মধ্যে ঈমানও নাই। বাস্তবতা হল, বাংলাদেশে যেমন সেক্যুলারিজমের জোয়ারে ভাসা ভারতপন্থি বহু ক্যাডার আছে, তেমনি প্যান-ইসলামের চেতনায় উজ্জিবীতত বহু লক্ষ মুসলমানও আছে। করিডোরের পথে চোখের সামনে মুসলিম হত্যাকারি ও মসজিদ ধ্বংসকারি ভারতীয়দের কাছে পেয়ে এদের কেউ কেউ যে তাদের উপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে না -সে গ্যারান্টি কে দেবে? তাছাড়া ১৯৪৭ সালে বাংলার মুসলমানগণ যে স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তা নিজ বাংলার বাঙালী হিন্দুদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নয়, বরং অবাঙালী মুসলমানদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে। সে চেতনা ছিল প্যান-ইসলামের। সেটি কি এতটাই ঠুনকো যে আওয়ামী বাকশালীদের ভারতমুখি মিথ্যা প্রচারনায় এত সহজে মারা মরবে? চেতনাকে শক্তির জোরে দাবিয়ে রাখা যায়, হত্যা করা যায় না। আর ইসলামি চেতনাকে তো নয়ই। ভারত সেটি জানে, তাই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের প্রচণ্ড ভয়।
তাছাড়া বাংলাদেশীদের প্রতি ভারতীয় সৈনিকদের আচরণটাই কি কম উস্কানিমূলক? প্রতি বছর বহু শত বাংলাদেশী নাগরিককে ভারতীয় বর্ডার সিকুরিটি ফোর্স তথা বিএসএফ হত্যা করে। তারকাটার বেড়ায় ঝুলে থাকে তাদের লাশ। এর কোন প্রতিকার বাংলাদেশীরা পায়নি। নিরীহ মানুষের এমন হত্যাকান্ড বিএসএফ পাকিস্তান সীমান্তে বিগত ৬০ বছরেও ঘটাতে পারিনি। এমনকি সেটি নেপাল, ভূটান বা বিশ্বের আর কোন দেশের সীমান্তেও ঘটে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারত সরকারের কাছে যে কতটা মূল্যহীন ও তুচ্ছ এবং দেশের জনগণ যে কতটা অরক্ষিত -সেটি বোঝানোর জন্য এ তথ্যটিই কি যথেষ্ট নয়? বহুবার তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েক কিলোমিটার ঢুকে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ইচ্ছামত ধরে নিয়ে যায় গরুবাছুড়। বাঁধ দিয়ে সীমান্তের ৫৪টি যৌথ নদীর পানি তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই। ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে এক তরফা ভাবেই তুলে নিয়েছে পদ্মার পানি। ষড়যন্ত্র চলছে টিপাইমুখ বাধ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি তুলে নেয়ার। বাঁধ দিয়ে পানিশূণ্য করা হচ্ছে তিস্তা। এদের মুখে আবার প্রতিবেশী মূলক সহযোগিতার ভাষা?
অধিকৃত বাংলাদেশ
ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার কারণ ভারতবিরোধী চেতনা এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। বেতনভোগী কয়েক হাজার র’এর এজেন্ট দিয়ে এমন চেতনাধারিদের দমন অসম্ভব। সেটি ভারতও বুঝে। তাই চায়, বাংলাদেশ সরকার ভারত বিরোধীদের শায়েস্তা করতে বিশ্বস্ত ও অনুগত ঠ্যাঙ্গারের ভূমিকা নিক। শেখ হাসিনার সরকার সে ভূমিকাই বিশ্বস্ততার সাথে পালন করছে দেশের শত শত ইসলামপন্থি নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন এবং ইসলামী বইপুস্তক বাজয়াপ্ত করার মধ্য দিয়ে। অথচ এটি কি কখনো কোন মুসলমানের এজেণ্ডা হতে পারে? শেখ হাসিনার সরকার রীতিমত যুদ্ধ শুরু করেছে দেশের ইসলামপন্থিদের নির্মূলে। সেটি শুধু জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নয়, সকল ইসলামী দলের বিরুদ্ধেই। কে বা কোন দল একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল সেটি তাদের কাছে বড় কথা নয়, বরং কারা এখন ইসলামের পক্ষ নিচ্ছে সেটিই তাদের বিবেচনায় মূল। এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নামছে। আওয়ামী বাকশালী পক্ষটি এমন একটি যুদ্ধের হুংকার বহু দিন থেকে দিয়ে আসছিল এবং এখন সেটি শুরুও হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ঘাড়ে এভাবেই চাপানো হয়েছে একটি অঘোষিত ভারতীয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ব্যয়ভার যেমন ভারতীয়রা বহন করছে, তেমনি কমাণ্ডও তাদের হাতে। বাংলাদেশ বস্তুত এ পক্ষটির হাতেই আজ অধিকৃত।
হাসিনা জনগণের সমর্থণ নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। জনপ্রিয়তা হারানো নিয়েও তার কোন দুর্ভাবনা নেই। সে দুর্ভাবনা ও দায়ভারটি বরং ভারতীয়দের। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। তখন বিপদে পড়বে ভারতের প্রায় বহু বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাজার। বিপদে পড়বে উত্তর-পূর্ব ভারতে তাদের যুদ্ধ। চট্টগ্রাম বন্দরে আটককৃত ১০ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে হাসিনা সরকার প্রমাণ করে ছেড়েছে তাঁর সরকার ভারতীয়দের স্বার্থের কতটা সহায়ক। বলা হয়, ১০ ট্রাক চীনা অস্ত্র আনা হয়েছিল উলফা বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছানোর জন্য। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুৎ হলে ভবিষ্যতে ১০ ট্রাক নয় আরো বেশী অস্ত্র যে বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছতে পারে –সে ভয়ে দিল্লির শাসকচক্র অস্থির। ভারতীয় নেতারা শিশু নয় যে তারা সেটি বুঝে না। সে জন্যই ভারত চায়, শেখ হাসিনার সরকার শুধু ক্ষমতায় থাকুক তাই নয়, বরং ভারতের সাথে উলফা বিরোধী যুদ্ধে পুরাপুরি সংশ্লিষ্ট হোক। এ যুদ্ধে যোগ দিক সক্রিয় পার্টনার রূপে, যেমনটি দিয়েছিল একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
লড়াই দেশ ও ঈমান বাঁচানোর
একাত্তরে যুদ্ধ ৯ মাসে শেষ হলেও এবারে সেটি হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশীদের কাঁধে চাপানো হচ্ছে এমন এক লাগাতর যুদ্ধ যা সহজে শেষ হবার নয়। তাছাড়া এ যুদ্ধটি আদৌ বাংলাদেশীদের নিজেদের যুদ্ধ নয়। বরং সর্ব অর্থেই ভারতীয় এবং সেটি ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণের।একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের যে উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ভারত এবার কোমর বেঁধেছে সেটিই পুরণ করতে। তাই ভারতের লক্ষ্য শুধু করিডোর লাভ নয়। সীমান্ত চুক্তি, সীমান্ত বাণিজ্য বা রাস্তাঘাট নির্মানে কিছু বিনিয়োগও নয়ও। বরং তার চেয়ে ব্যাপক ও সূদুর প্রসারী। সেটি যেমন দেশের ইসলামি চেতনার নির্মূল ও ইসলামপন্থি দেশপ্রেমিকদের কোমর ভাঙ্গার,তেমনি দেশটির উপর পরিপূর্ণ অধিকৃতি জমানোর। মি. ভার্মার ন্যায় ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা সে অভিলাষের কথা গোপন রাখেনি, তেমনি গোপন রাখছেন না বহু ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাও। বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা তো সিলেট থেকে খুলনা বরাবর বাংলাদেশের অর্ধেক দখল করে নেয়ার দাবীও তুলেছেন। মুজিবের ন্যায় হাসিনাও চায় ভারতের ইচ্ছা পূরণ। কারণ, ক্ষমতায় থাকার জন্য সেটি গুরুত্বপর্ণ। তাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, জিহাদের ন্যায় ইসলামের মৌল শিক্ষার প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইসলামী সংগঠনগুলির নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। বস্তুতঃ এসব করা হচ্ছে বাংলাদেশকে ভারতীয় মানচিত্রে বিলীন করার লক্ষ্যে। রাজনৈতিক মানচিত্র বিলুপ্ত না করলেও ইতিমধ্যই বিলুপ্ত করতে পেরেছ সাংস্কৃতিক মানচিত্র। বাংলাদেশীদের সামনে লড়াই এখন তাই শুধু গণতন্ত্র উদ্ধারের নয়। বরং তার চেয়েও গুরুতর। সেটি দেশ বাঁচানোর। এবং সে সাথে ঈমান ও ইসলাম বাঁচানোর।