অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অবশেষে বন্ধ হলো বিশ্ব প্রতারক ও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. শাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। প্রতারণা, অনিয়ম, দুর্নীতির কোন কিছুই বাদ নেই যা ওই হাসপাতালটির মাধ্যমে শাহেদ করেনি। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেছেন-শাহেদ নিজেই অফিসে বসে বসে এসব অপকর্ম করতেন।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো-রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকলেও ছলে বলে কৌশলে শাহেদ এটাতে করোনা চিকিৎসার অনুমিত নিয়েছিলেন। আর এটাও করেছেন তিনি দলীয় ক্ষমতার বলে।
দেখা গেছে, ব্যক্তিগত গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার। সঙ্গে গানম্যান নিয়ে চলতেন শাহেদ। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি বিলবোর্ডে সাঁটিয়ে দিয়েছেন হাসপাতালের সামনে। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ওবায়দুল কাদের, তোফায়েল আহমেদ, হানিফ, সেনাপ্রধান, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজির, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হকসহ সরকারের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই যার সঙ্গে শাহেদের ছবি নাই।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ মনে করছেন, শাহেদের এসব প্রতারণা, দুর্নীতির সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা জড়িত আছেন। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই শাহেদ এসব করতে পারছে। অন্যথায় সম্ভব হতো না। দতারা বলছেন, শেখ হাসিনার গণভবন থেকে শুরু করে থানার ওসি পর্যন্ত শাহেদের এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। সঠিকভাবে তদন্ত করলে সব রাঘব বোয়ালদের নামই বেরিয়ে আসবে।
কে এই শাহেদ?
মো. শাহেদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকলেও তার আসল নাম মো. শাহেদ করিম, পিতা: সিরাজুল করিম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ি তার ঠিকানা হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১। গ্রামের বাড়ী সাতক্ষীরা জেলায়। ১/১১ সরকারের সময় তিনি দুই বছর জেলে ছিলেন বলে তার ঘনিষ্টজনরা বলছেন। জেল থেকে বের হয়ে শাহেদ ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নং রোডে এমএলএম কোম্পানী বিডিএস ক্লিক ওয়ান খুলে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারনা করে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আর সেসময় তিনি মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী বলে পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় ২টি মামলা, বরিশালে ১ মামলা, বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিস এ চাকুরীর নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারনার কারণে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে বলে সূত্রের দাবি।
এছাড়াও প্রতারণার টাকায় তিনি উত্তরা পশ্চিম থানার পাশে গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট কলেজ ও ইউনির্ভাসিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। এর একটিরও কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। আর অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে শাহেদের বিরুদ্ধে। প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিতে নিজের কার্যালয়ে একটি টর্চার সেল গড়ে তুলেছিলেন বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
রিজেন্টের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪২৬৪টি স্যাম্পল রিজেন্ট টেস্ট করেছে এবং এর বাইরে ৬ হাজারের বেশি স্যাম্পল টেস্ট না করেই তারা ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ২০১৪ সাল থেকে নেই। আর আইসিইউ যেটা আছে সেটা ভালোভাবে চলছিলো না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডায়াগনোসিস ল্যাব আছে, সেখানে কোনো মেশিন নেই, সেখানে কোনো টেস্ট না করেই রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, অভিযান চলাকালে ফ্রিজের মধ্যে এক অংশে মেডিসিন অন্য অংশে মাছ মিলেছে। হাসপাতালটির ডিসপেনসারি সেখানে সব সার্জিক্যাল আইটেম ৫/৬ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ। নেই মালিকের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন। এর আগে প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালানোর সময় বেশ কিছু রিপোর্ট সেগুলো হাসপাতালে থাকার কথা সেগুলো মিলেছে রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে। র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, যেই চিকিৎসা বিনামূল্যে করার কথা সেটির জন্য রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার সরকারের কাছ থেকেও সেই টাকা গ্রহণ করেছে হাসপাতালটি।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার বলেন, ‘করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা এবং বাড়িতে থাকা রোগীদের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করতো রিজেন্ট হাসপাতাল। এ ছাড়াও সরকার থেকে বিনামূল্যে করোনা টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্ট প্রতি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আদায় করতো তারা। এভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট। এই সমস্ত অপরাধ ও টাকার নিয়ন্ত্রণ চেয়ারম্যান সাহেব (রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদ) নিজে করতেন অফিসে বসে।’
সারোয়ার আলম বলেন, ‘রিজেন্টের প্রধান কার্যালয় থেকেই এই অপকর্মগুলো হতো বিধায় এটি সিলগালা করা হয়েছে। পাশাপাশি রোগীদের স্থানান্তর করে হাসপাতাল দুটিও সিলগালা করা হয়েছে।’ এর আগে সোমবার রাতেই মো. সাহেদের মালিকানাধীন হাসপাতাল থেকে অননুমোদিত র্যাপিড টেস্টিং কিট ও একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ওই গাড়িতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখে ধুলো দিতেই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার ব্যবহার করা হতো।
৫০ শয্যার রিজেন্ট হাসপাতালটিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদন দিয়েছিলো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। পরে ২০১৭ সালে মিরপুরেও হাসপাতালটির আরেকটি শাখা খুলে তার অনুমোদন যদিও এসব হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ একবার উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর নবায়ন করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
দেখা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদের বাবাও করোনা আক্রান্ত হন। তবে তাকে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে ভর্তি করানো হয় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। বিষয়টি জানা যায়, এই হাসপাতালের একজন সাবেক কর্মীর মাধ্যমে। তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি রিজেন্ট হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। তাকে ফোন দিয়েছিলেন মো. শাহেদ। তিনি প্লাজমা দেয়ার আবেদন জানিয়ে ছিলেন তার কাছে। তবে রক্তের গ্রুপ না মেলায় তিনি প্লাজমা দিতে পারেন নি। এ ছাড়াও নিজের ফেসবুক ওয়ালে বাবার জন্য বি পজেটিভ প্লাজমার জন্য আবেদন করে পোস্টও দিয়েছিলেন শাহেদ। তিনি ওই কর্মীকে জানিয়ে ছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে তার বাবা চিকিৎসা নিচ্ছেন।