অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার যেসব কারণে সবচেয়ে সমালোচিত তার অন্যতম কারণ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে বেপরোয়া লুটপাট। শেয়ারবাজার লুট থেকে শুরু করে ঋণখেলাপির মাধ্যমে এত পরিমাণ ব্যাংকলুট করা হয়েছে যে, দেশের প্রায় সকল ব্যাংকই এখন জীর্ণদশায় ভূগছে।
ঋণখেলাপির কারণে এরই মধ্যে দেউলিয়া হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। সেই তালিকায় প্রবেশ করার জোর প্রচেষ্টায় রয়েছে আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী সিকদার গ্রুপের দখলে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নানামুখী সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি এবং লোকসানি শাখার কারণে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে সময় পার করছে প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটি। ৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপির খাতায় যার অবস্থান এখন দ্বিতীয়।
এভাবে ক্ষমতাসীনদের আশকারায় লুটিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। দেউলিয়া করছে দেশের ব্যাংকিং খাত। তারাই ধারাবাহিকতায় এবার চোখ পড়ে এক্সিম ব্যাংকের ওপর। জামানত না দিয়ে এক্সিম ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চায় সিকদার গ্রুপ। এই টাকা দিতে অস্বীকার করলে ব্যাংকের এমডিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও করা হয়।
জানা যায়, ঋণের জন্য বন্ধকি দেওয়া সম্পত্তি দেখাতে নিয়ে গিয়েই জিম্মি করা হয় এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে। এরপর অস্ত্রের মুখে বনানীর বাসায় ধরে এনে নির্যাতন চালায় সিকদার গ্রুপের লোকজন। ব্যাংকটির এমডিকে উদ্দেশ করে গুলিও ছোড়েন সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হায়দার আলী মিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যানও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এক ধনিক গোষ্ঠী গুলি করেছে, আরেক গোষ্ঠী তাদের রক্ষা করতে চেয়েছে। এ জন্য মামলা নিতে বিলম্ব হয়েছে। আমাদের সন্দেহ হয়, এই মামলা কি কখনো আলোর মুখ দেখবে। যেমনভাবে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই ধোরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন, এরাও একইভাবে পাড় পেয়ে যাবে কি না। এমন ঘটনা নতুন নয় এরকম বহু ঘটনা অগোচরেই রয়ে গেছে।
ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ মদদ
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ব্যাংকারদের নিয়ে আমরা আগ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন শুনে আসছি। তাঁরা চাপে আছেন, আবার কেউ কেউ ঘুষ নিয়ে কাজ করছেন। এখন যেটা জানা গেল, সেই চাপটা ভয়ংকর। একজন এমডিকে ডেকে নিয়ে গুলি করা, বাসায় নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো সাংঘাতিক ব্যাপার। ক্ষমতাসীন দলের ইন্ধনে ছাড়া একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করার ঘটনা চিন্তাও করা যায় না। সিকদার গ্রুপের সাথে সরকারের ঘনিষ্ঠতা অনেক আগের। সরকার তাদেরকে দিয়ে মুলত ব্যাংকিং খাত জিম্মি করে রেখেছে। দেউলিয়া করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
দেখা গেছে, আইন নয় সরকারি মদদে কয়েকটি ধনী গ্রুপ আমাদের শাসন করছে। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে একের পর এক ব্যাংক লুট করে চলছে সিকদার গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যখন ৩ হাজার কোটি টাকার উর্ধে খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে সেই মুহুর্তেও ক্ষমতাসীনরা কথিত মুজিব বর্ষের অনুদানের নামে ১০ কোটি টাকা লুটিয়ে নেয়। শুধু তাই নয় ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক এভাবে লুট করার চেষ্টা করে চলছে।
দেখা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক দলীয় বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। এসব ব্যাংকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের বহু নেতাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কেবল মাত্র রাজনৈতিক কারনেই একের পর এক দব্যাংক এখন দেউলিয়া হতে চলেছে। সরকারি আশকারায় তারা এসব কাজ করে আসছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ব্যাংকিং খাতের এ লুটপাটের কথা বিভিন্ন সময় স্বীকারও করেছেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে লুটপাট হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতে শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি হয়েছে।
এদিকে গভর্নর ফজলে কবিরকে রাখতে আইন সংশোধন করছে সরকার। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ বৃদ্ধির আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তাঁর বয়স ৬৫ বছর ছুঁই ছুঁই। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী, ৬৫ বছর বয়স হয়ে গেলে আর কেউ গভর্নর থাকতে পারেন না। তারপরও সরকার তাঁকে আরেক দফায় গভর্নর পদে রাখতে চাইছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু ফজলে কবিরকে আবার নিয়োগ দিতেই সংশোধন করা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। তিনি দুই বছরের জন্য নিয়োগ পেতে পারেন। এখন যেহেতু জাতীয় সংসদের কোনো অধিবেশন নেই, তাই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এ অর্ডার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
একের পর এক ব্যাংক লুট
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভোট ডাকাতির নির্বাচনে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক লুট হচ্ছে ব্যাংক। বিভিন্ন সময় ভুয়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় ঋণপত্র খুলে যেমন টাকা আত্মসাৎ করছে; আবার কাগুজে কোম্পানির নামেও ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের জালিয়াতি করতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে যোগসাজশ ছিল। রাজনৈতিক প্রভাবেই ব্যাংক খাতে এসব কেলেঙ্কারি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি বেড়ে ৩ হাজার ২৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসে ব্যাংকটির আড়াই গুণের বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১২৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬১ কোটি টাকা। এতে মাত্র ৯ মাসেই ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৭৩৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৬ সাল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসানি শাখা ছিল ৩৩টি।
চৌধুরী মোশতাক আহমেদ ন্যাশনাল ব্যাংকে যোগদানের আগে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি ছিলেন। সে সময় ব্যাংকটিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করা ও মিথ্যা তথ্য দেয়ায় চৌধুরী মোশতাককে জরিমানা করা হয়।
অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেছেন, সিকদার গ্রুপ যদি ৫০০ কোটি টাকা বের করে নিতে পারত, তাহলে ব্যাংকটির স্থায়ী ক্ষত তৈরি হতো। সেটি ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীরা। এখন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা যদি মালিকদের কাছ থেকে নিরাপত্তা না পান, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে থাকবেই। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করি না। বরং ঋণখেলাপিদের সরকার যেভাবে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে আশকারা দিয়ে চলেছে, এই ঘটনা সেখান থেকে উদ্ভব হয়েছে। অতএব আগে সেখানেই হাত দিতে হবে।