– রুদ্র আহনাফ
প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্তের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সরকার একদিকে আতঙ্ক না ছড়ানেরা জন্য করোনার তথ্য গোপন করছে অন্যদিকে বন্ধের ঘোষণা দিয়েও খুলে দিচ্ছে যাতায়াতের সকল পথ। আর আপনি আমিও সে ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছি মৃত্যুর দিকে। শুধু কি তাই? নিজেদের পরিবারের সদস্যদেরও ফেলছি মৃত্যু ঝুঁকিতে।
সরকার বাহাদুরের কালো বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে নির্বিঘ্নে শহর ছাড়তে বা প্রবেশ করতে পারবে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পুলিশের অস্থায়ী চেকপোস্টগুলোও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাদের জন্য এই আইন? আচ্ছা, যে ব্যক্তি পরিবারের হাসি ফুটনোর জন্য এই ঢাকা শহরে সামান্য চাকরি করে তার জন্য কি তাহলে ঈদ নয়? ঈদ কি শুধুই তাদের জন্য যাদের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে? যদিও এ ঘোষণার পর প্রাইভেট কারে বা মাইক্রোবাসে শুধু গাড়ির মালিকেরাই যাননি। উচ্চ ভাড়া পরিশোধ করে সামাজিক দূরত্বের কোনো তোয়াক্কা না করে মানুষ ছুটেছে নিজ নিজ গৃহের উদ্দেশ্যে।
গত কয়েক দিনে দেখা গেছে ঢাকা থেকে দক্ষিণের ২১টি জেলায় যাওয়ার অন্যতম ফেরিঘাট শিমুলিয়ায় মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেট কার সহ ছোট ছোট যানবাহন নিয়ে শত শত মানুষের উপচেপড়া ভিড়। একই দৃশ্য দেখা গেছে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার অন্যতম প্রবেশ পথ মাওয়া ঘাটেও। সীমিত পর্যায়ে এতদিন দু’ একটি ফেরি চললেও প্রশাসনের এমন ঘোষণার পর ঘরমুখো মানুষের চাপ সামলাতে প্রায় সবগুলো ফেরিই চালানো হয়েছে। উপচে পড়া মানুষ নিয়ে ফেরি চলাচলের দৃশ্য নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা। কেউ সাধারণ মানুষের দায়ী করছেন আবার অনেকেই সরকারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারী খুব সহজেই বিদায় নিচ্ছে না। আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও সম্ভব হবে না। তাই নিয়ম-কানুন মেনে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই ভিন্নতর স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রস্তুতি নিতে হবে সবাইকে। সরকারকে দেখাতে হবে নিরাপত্তা দেয়ার যোগ্যতা, জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। অর্থাৎ করোনা মহামারীর সাথে বসবাস সম্ভব করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকারকেই প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্য দেশগুলোতেও করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারি চেষ্টার শেষ নেই। কারণ, করোনাভাইরাস শুধু জীবনের জন্য বিপদ নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্যও ভীষণ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
মরণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নেতৃত্বদানে সরকারের প্রস্তুতির অভাব এবং অসংগঠিত অবস্থা এখন স্পষ্ট। চারপাশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের অভাব থাকায় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করাও সম্ভব হচ্ছে না। ভোট ডাকাতির সরকার যে জনবান্ধব নয় বরং জনবিরোধী। এই মহামারির সময়েও সেই নির্মম সত্যই প্রমাণিত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা না করেই পুনরায় দোকানপাট, শিল্প-কারখানা খুলে দিয়েছে সরকার। খামখেয়ালিপনা ও দায়িত্বহীনতার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। বিশ্বে স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ নিশ্চিত না করে দোকানপাট বা মিল-কারখানা চালু করার অর্থ যে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত তা পাগলেও বুঝে। তবে করোনার বিস্তার ঘটানোর মধ্য দিয়ে সরকার আসলে কি হাসিল করতে চায় সেটি কারও কাছেই স্পষ্ট নয়।
এদিকে লকডাউনের ফলে ঢাকার পথে ঘাটে এখন ভিক্ষুকের সারি। কোথাও রিক্সা বা অন্য কোনো বাহন থেকে নামার সাথে সাথে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে কর্মহীন নিম্নবিত্ত মানুষের দল। নিম্ন বিত্ত এসব মানুষের ভাগ্যে সরকারি ত্রাণ আদৌ জুটেছে কিনা তা কে জানে! পত্রিকা খুললেই তো চোখে পড়ছে সরকারি দলের গুন্ডা ষন্ডাদের চাল, ডাল, তেল চুরির খবর। টিভি খুললেও একই অবস্থা। সরকার দলীয় এসব গুন্ডারা নিজেদের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে অত্যন্ত সাহসের সাথে লুটে নিচ্ছে ভাগ্যাহত মানুষের অর্থ। ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডবে ভেসে গেছে উপকুলীয় জনগণের ভাগ্য। সবমিলিয়ে দেশের যে অবস্থা তাতে মানুষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
এর মধ্যেই অবশ্য চলে এসেছে ঈদুল ফিতর। মুসলিমদের সবচেয়ে আনন্দের দিন। কিন্তু এত এত দুঃখ, জরা আর আতঙ্ক মাথায় নিয়ে মানুষের মনে সত্যিই কোনো আনন্দ নেই। এমতাবস্থায় লকডাউন শিথিল করে সরকার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি! প্রতিদিনের নিউজ আপডেট দেখে তো জনগণের বুঝতে পারার কথা। প্রতিদিন বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। লাফিয়ে বাড়ছে লাশের সারি। অথচ এসব দেখেও যেন সবাই নির্বিকার। হুড়াহুড়ি করে ঈদের ছুটিতে কে কখন কার আগে বাড়ি পৌঁছাবে তার প্রতিযোগীতায় যেন সবাই মত্ত।
একবারও যেন কেউ ভাবার সুযোগ পাচ্ছে না যে, আমরা আমাদের পরিবারের জন্য এই মরণঘাতী ভাইরাস বহন করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি নাতো? আমাদের খামখেয়ালি আর গোয়ার্তুমির কারণে কোনো নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে যাবে নাতো! একটু আনন্দ উপভোগ করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই মৃত্যুমুখে পতিত হবো নাতো? এসব প্রশ্ন যদি সবাই নিজেকে একবারের জন্যও করতো তবে ফেরিঘাটে আর প্রাইভেট কার- মাইক্রোবাসে উপচে পড়া ভীড় দেখা যেত না।
আবেগে আমরা হয়তো বিশ্ববাসীকে এবার হার মানিয়ে দিলাম। কিন্তু তাতে যদি (আল্লাহ না করুন) করোনায় আক্রান্ত হয়ে লাশের মিছিল দীর্ঘ হয়, তার দায় সরকারের পাশাপাশি এসব আবেগী মানুষদেরও বহন করতে হবে। একটু চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আপনার প্রিয়জনকে আপনি নিরাপদে রাখতেই পারতেন!