অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর সময় দেশের স্বাস্থ্যখাতে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে আরও বেশি আতঙ্ক হয়ে দাড়িয়েছে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই সারাদেশে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ রোগীরা চরম বিপাকে আছে। বিশেষ করে জ্বর, সর্দি, কাশি, হাপানি, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা বর্তমানে কোথায়ও চিকিৎসা পাচ্ছে না।
এসব রোগ নিয়ে কেউ হাসপাতালে গেলেও কর্তৃপক্ষ করোনা সন্দেহে তাকে ভর্তি করছে না। আবার কোথাও কোথাও ভর্তি করলেও ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছে না। অনেকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে কোথাও ভর্তি হতে না পেরে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
দেখা গেছে, গত এক মাসে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহী, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাসহ আর কয়েকটি জেলায় কমপক্ষে ১১ জন নারী-পুরুষ ও শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। ৫ থেকে ১০টি হাসপাতালে ঘুরেও তারা ভর্তি হতে পারেনি। এসব কারণে সাধারণ রোগীরা এখন নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছে।
কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তারদের ওপর একটু ক্ষোভ প্রকাশ করলেও পরে এসব নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তাররা তাদের খেয়াল খুশি মতোই সব কিছু চালাচ্ছে।
১১ হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি
দেখা গেছে, শনিবার সন্ধ্যায় বিনা চিচিৎসায় আমিনুল ইসলাম নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল। এভাবে রাজধানীর ১১টি হাসপাতালে আমিনুলকে নিয়ে ঘুরেছেন তার স্ত্রী মিনু বেগম। কোনো হাসপাতালেই চিকিৎসা হয়নি আমিনুলের (৫২)। মিনু বেগমের কাকুতি মিনতি কেউ শুনেনি। সর্বশেষ শনিবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হয় তাকে। তখন দিন ঘনিয়ে সন্ধ্যা। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওনা দেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ওই হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যান আমিনুল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা কোন দেশ বাস করছি? যে দেশে একজন মানুষের চিকিৎসা করানো যায় না। এই দেশ আমাদের না?। সরকার বলছে যে কোনো সাহায্যের জন্য ৯৯৯ এ ফোন দেয়ার জন্য। এখানে ফোন দেয়ার পর তারা বলে বিষয়টি দেখছি। এর পর আর কোনো সারা শব্দ নেই। আইইডিসিআর এ এক সপ্তাহ ধরে ফোন দিয়ে গত ১২ তারিখ তাদেরকে পেয়েছি। তাদের কাছে উপায় না পেয়ে আমার স্বামীর উপসর্গগুলো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছিলাম। যেন তারা আমার স্বামীর জন্য দ্রুত কিছু একটা করে। সেই দিন বলেলো পরের দিন এসে নমুনা নিয়ে যাবে । আজ পর্যন্ত তাদের কেউ আমাদের কাছে আসেনি। গত পাচঁটা দিন তাদেরকে হাজার বার ফোন দিলাম কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।
কুর্মিটোলা হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় সিপিবি নেতার মৃত্যু
১৯ এপ্রিল সকালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নারায়ণগঞ্জ মহানগরের ১৪নং ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক বিকাশ সাহা।
বিকাশ সাহার ছেলে অনির্বান সাহা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে কোন চিকিৎসা দেয়া হয় না। ডাক্তার, নার্সরা ছুঁয়েও দেখে না। শ্বাসকষ্ট ছিল বাবার, বারবার নার্স ডেকেছি কিন্তু কেউ আসে নাই। শনিবার ১টার দিকে হাসপাতালে নিয়েছিলাম কিন্তু ভর্তি নিয়েছে বিকাল ৪টায়। সবকিছুতে গাফিলতি তাদের। শনিবার থেকে এ পর্যন্ত ডাক্তার আসে নাই। চিকিৎসার অভাবে বাবা মারা গেছেন।
বনানীতে বিনা চিকিৎসায় করোনা রোগীর মৃত্যু
১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির লকডাউন করা একটি বাড়িতে মারা যান এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তির ছেলের অভিযোগ করে বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে আইইডিসিআর হটলাইনে চিকিৎসার জন্য ফোন করেছিলাম। ওয়েটিং দেখিয়ে ফোনটি বারবার কেটে যায়। একাধিকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পুলিশকে জানাই। বুধবার দুপুরে বনানী থানা পুলিশ এসে বাসাটি লকডাউন করে দেয়। করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে বহুবার চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে। কিন্তু কে শোনে কার আকুতি।
যশোরে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু
১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার করোনা সন্দেহে যশোর জেনারেল হাসপাতালের কোয়ারেন্টিনে থাকা আলমগীর কবীর সনু (৪৫ ) মারা যান।
তার স্ত্রী সানজিদা কবীর অভিযোগ করেন, হাসপাতালের ডা. উজ্জ্বলের অবহেলার কারণে তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি কখনোই ওই ডাক্তারকে ক্ষমা করবেন না বলে জানান। বারবার তাকে খবর দেওয়ার পরেও ওই চিকিৎসক রোগীকে দেখতে আসেননি।
আমার স্বামীর ডায়ালাইসিস করার ব্যবস্থা করার বিষয়ে আগে থেকেই হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহিত করি। তারাও আমাকে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু, ওই হাসপাতালের কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ ডা. উজ্জ্বল দীর্ঘ এই সময়ে আমার স্বামীর কিডনি ডায়ালিসিসের কোনও ব্যবস্থা করেননি। এমনকি বুধবার রাতে (১৫ এপ্রিল) যখন আমার স্বামীর অবস্থা বেশ খারাপ, তখন ওয়ার্ডে থাকা সিস্টার ও আমি মিলে ডা. উজ্জ্বলকে কমপক্ষে ৫০ বার ফোন দেই। কিন্তু তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি। ওই রাতে যদি আমার স্বামীর ডায়ালাইসিস করা যেতো, হয়তো তিনি মারা যেতেন না।
বিনা চিকিৎসায় প্রকৌশলীর মৃত্যু
ঢাকার সাভারের জয়নাবাড়ি এলাকার প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের (৫২) শরীরে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ছিল। এসব উপসর্গ নিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পর তাঁকে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপর এ-হাসপাতাল, ও-হাসপাতাল করে অবশেষে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
জসিম উদ্দিনের শ্যালক ইকবাল হোসেন বলেন, তাঁর ভগ্নিপতি বুধবার থেকে শরীরে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। রোববার বেলা একটার দিকে তাঁকে এনাম মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। বিকেলের দিকে তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তাঁকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁরা রাজি না হওয়ায় হাসপাতালের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আনসার ডেকে আনেন। রাত ১০টার দিকে তাঁর ভগ্নিপতিকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
চার হাসপাতাল ঘুরে শিশুর মৃত্যু
রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি চারটি হাসপাতাল ঘুরেও একটি চিকিৎসা না পেয়ে জিসান সরদার (১১) নামে একটি শিশু গত ১০ এপ্রিল মারা যায়।
খুলনায় বিনা চিকিৎসায় স্কুলছাত্রের মৃত্যু
গত ১ এপ্রিল খুলনায় চারটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। রিফাত নগরের খালিশপুর হাউজিংয়ে এক নম্বর বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা পাটকল শ্রমিক মো. কাশেমের ছেলে। সে খালিশপুর ওব্যাট প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
স্বেচ্ছাসেবী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওব্যাটের প্রকল্প কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর রিফাতের নানা মো. কলিমুদ্দীনের বরাত দিয়ে বলেন, রিফাত অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। গত মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক নেই বলে সেখানে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। এরপর নেওয়া হয় আদদ্বীন হাসপাতালে। সেখানেও তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। এরপর অবস্থার অবনতি হলে রিফাতকে খালিশপুর ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিফাতকে গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। গাজী মেডিকেলে নেওয়া হলে তারা জানায়, চিকিৎসক নেই। তাই রোগী ভর্তি করা যাবে না। হাসপাতালে হাসপাতালে ভর্তির জন্য ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যায় রিফাত মারা যায়।
খুমেকে সিঁড়িতে রোগীর মৃত্যু
পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার জয় বাংলা গ্রামের বাসিন্দা বাবুল (৪০)। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ঘণ্টাখানেক পর ৪ এপ্রিল বাবুলের মৃত্যু হয়।
পরিবারের অভিযোগ- এই সময়টা তারা হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগে দৌড়াদৌড়িতেই পার করেছেন। করোনা সন্দেহে কোনো ডাক্তারই তাকে চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেননি। যার কারণে বাবুলের মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসা দেয়নি ৫ হাসপাতাল, ধুঁকে ধুঁকে যুবকের মৃত্যু
করোনা আক্রান্ত সন্দেহে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেছেন আল আমিন নামের এক যুবক। তার বাড়ি নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার অলংকার দিঘি গ্রামে।
নারায়ণগঞ্জ ফেরত যুবক আল আমিন (২২) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ মার্চ মারা যান। নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতাল, আদমদিঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, রানীনগর উপজেলা হাসপাতালসহ পাঁচটা হাসপাতাল ঘুরেও কোনো চিকিৎসা না পেয়ে শনিবার বিকালে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে রাত সাড়ে আটটার দিকে আল আমিন মারা যান।
বিনা চিকিৎসায় মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু
রাজধানীর ৪টি হাসাপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে ২৯ মার্চ মো. আলমাস উদ্দিন নামে এক মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু হয়েছে।
৬৮ বছর বয়সী আলমাসের মৃত্যুর আগে তার পরিবার চার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করোনা সন্দেহে কোনো হাসপাতালই তাকে ভর্তি করেনি। আলমাস উদ্দিনের বড় ছেলে আরিফ হাসানের অভিযোগ, শনিবার ভোরে তার বাবা বাসাবোর নিজ বাসায় ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন।
এর পর তাকে বারডেম হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল ও কুয়েতমৈত্রী হাসপাতালে নেয়া হলে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে কোনো হাসপাতালই ভর্তি করতে রাজি হয়নি। ‘পরে রাত ১২টায় মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হলেও ততক্ষণে তার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে। এ অবস্থায় রোববার সকালে সেখানেই মারা যান বাবা।’
কুষ্টিয়ায় চিকিৎসায় নারীর মৃত্যুর অভিযোগ
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক নারীর (৪৩) বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। রোববার (১২ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
মৃত নারীর স্বামী জানান, শুক্রবার সকালে মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে ভর্তি বা চিকিৎসা না দিয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে ডাক্তার দেখে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। ওই ওয়ার্ডে রেখে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। বিনা চিকিৎসার ফলেই মারা গেছে।