আবিদা সুলতানা উমামা
১
সবুজাভ এক প্রাণবন্ত সময়ের কথা মনে পড়ছে। আমার তখন উচ্ছলতামুখর শৈশবের সাতরঙা সকাল-দুপুর। জগৎ-সংসারের তাবৎ কিছুর প্রতি কৌতূহল জাগা দিন। রাজ্যের সব প্রশ্ন ভর করে থাকত মনে-মগজে। সে সব প্রশ্নের অদ্ভুত সব উত্তর দিতেন নূর ভাইয়া। আমাকে মাদরাসায় আনা-নেওয়া করতেন তিনি। আর পথে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিতেন আমার সব প্রশ্নের। তখনকার কথা। এক মেঘলা দুপুরে মাদরাসা থেকে ফিরছি। হঠাৎ সে কী ঝমঝম বৃষ্টি! আচমকা বৃষ্টির কবলে পড়ে অন্য সবার সাথে আমরাও এক দোকানের ছাউনিতলায় দাঁড়ালাম। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই, থামার কোনো নামগন্ধ নেই। এমন বর্ষণে কেমন করে যেন মনে পড়ে গেল ক্লাসে বাংলা হুজুরের শোনানো কবিতাটার কথা। ‘কে কী বলবে’—সেটার তোয়াক্কা না করে আমি জোর গলায় সুর তুলে পড়তে শুরু করলাম,
বিষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে
আমার শৈশবে এই কবিতাটার রাজত্ব ছিলো দীর্ঘ একটা সময়জুড়ে। নাগরিক শৈশবে আমার কখনো কাশবন কিংবা বকের সারি দেখার সুযোগ মেলেনি। নদীতে নাই খেয়া যে/ডাকলো দূরে দেয়া যে-র দৃশ্যও কখনো অবলোকন করার সুযোগ হয়নি। আমি শুধু অনুভব করতাম মেঘের আধার মন টানে/ যায় সে ছুটে কোন খানে আর কবির কবিতার ছন্দে কল্পনার ভেলায় চড়ে পৌঁছে যেতাম আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে/আমন ধানের দেশ পানে ।
আমার শিশুমনে যার কবিতা সঞ্চার করেছিল প্রাণচাঞ্চল্য, শিশুদের জন্য এমন রঙ-রসে ভরপুর নানান লেখা লিখেছেন যিনি, মানুষটি আর কেউ নন—রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ।
তাঁর কবিতা রঙিন করেছে আমার ভাবনার জগৎ। ছোট ছোট বিষয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁর কবিতারা আমাকে নিয়ে গেছে কবির উচ্ছলতামুখর শৈশবের ছায়ায়। যেখানে তিনি দেখেছেন সবুজ-শ্যামল ছবি, ভোরে চোখ মেলেছেন পাখির কলরবে, অনুভব করছেন নদীর আহ্বান, বৃষ্টির ডাক আর জোছনার হাতছানি। শহুরে শৈশবের অলস বিকেলগুলোতে তাঁর কবিতা আমাকে নিয়ে গেছে পায়ে হেঁটে চলা সেই মেঠোপথে, যে পথ ধরে কবি হেঁটে বেড়িয়েছেন আশৈশব।
আমার শৈশবজুড়ে কবি ফররুখের কবিতার প্রভাব এতই বেশি ছিল—জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একটা সাদা বিড়ালকে চুপিচুপি প্রবেশ করতে দেখেও আমি কখনো তাড়িয়ে দিতাম না। আওড়াতাম,
বাঘের খালা বিল্লী
আসলো ঘুরে দিল্লী
তুলতুলে চার বাচ্চা
বলছি আমি সাচ্চা
২
ক্লাস থ্রিতে উঠার পর নানা আমাকে একটা ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন। আর আমার যিনি গৃহশিক্ষক ছিলেন, তিনি উপহার দিয়েছিলেন কয়েকটা লিটলম্যাগ। তখন নতুন নতুন পড়তে শুরু করেছি তো, তাই যেকোনো কিছু হাতের কাছে পেলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। কিচ্ছুটি বাদ দিতাম না। যে ছড়াটা বেশ ভালো লাগত, যে কবিতাটা পড়ে আনন্দ পেতাম—ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতাম। স্যারের দেওয়া ম্যাগাজিনগুলোও বাদ যায়নি। ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে একটা ছিলো কবি ফররুখ আহমদকে নিয়ে। পুরনো অভ্যাসমতো, তাঁকে চেনার পর থেকে যখন যেখানে তাঁর সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি, তাঁর কবিতা পেয়েছি টুকে রেখেছি ডায়েরিতে। আরেকটু বড় হয়ে, তাঁর সম্পর্কে কোথাও কোনো লেখা পেলে সে পেপার কাটিং সেঁটে রেখেছিলাম ডায়েরির পাতায়। প্রিয় যেকোনো কিছু নিয়ে এ আমার অদ্ভুত পাগলামো। এই পাগলামো থেকে বাদ যায়নি ফররুখ আহমদের জন্ম-মৃত্যুর বর্ণনা কিংবা শৈশব-কৈশোরের টুকরো কথাও।
আমার প্রিয় প্রতিভাবান এই কবির জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ই জুন। পবিত্র রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে দাদীমা তাঁকে আদর মেখে রমজান বলে ডাকতেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। লালিত পালিত হন দাদীর স্নেহের ছায়ায়। তাঁর দাদী একজন বিদুষী নারী ছিলেন। যদ্দুর জানা যায়—পূণ্যবতী দাদীমার কাছেই কবির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। কাব্যমানসও হয়তো তৈরি হয়েছিল তাঁরই সান্নিধ্যে থেকে। কৈশোরে পিতাকে হারান। তারপর চলে যান বড় ভাইয়ের কাছে। স্কুল-জীবনের উচ্ছল দিনগুলোতেই কবি সংস্পর্শ পান খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের।
ডায়েরিতে টুকে রাখা তাঁর কলেজ জীবনের একটি ঘটনা বলি।
সেদিন বাইরে ভীষণ বৃষ্টি। কবি ফররুখ ভিজে গিয়েছিলেন। পথের কাঁদা ছিটকে এসে কাপড়ে লেগে গিয়েছিল। এই অবস্থায়ই কলেজে হাজির হন। জায়গা খুঁজে বসেন একেবারে পেছনের টেবিলে। ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমণাথ বিশী। এদিকে ফররুখ আহমদ মনোযোগ দেন অন্য কাজে। সবার অলক্ষ্যে তিনি খাতা খুলে লিখতে শুরু করেন। কেউ খেয়াল না করলেও শিক্ষকের দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পড়ে যান। টের পেয়ে লুকোতে চেষ্টা করেন খাতাটি। কিন্তু ততক্ষণে শিক্ষক প্রমণাথ বিশী ঠিকই ধরে ফেলেছেন। খাতা খুলে দেখতে পান তাঁর ছাত্রের খাতায় নোটসের পরিবর্তে লেখা আছে সনেট। কয়েকটা পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। টিচার্স কমনরুমে আবৃত্তি করে ঘোষণা করেন, আমি একজন তরুণ শেক্সপিয়র আবিষ্কার করেছি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসুও। তিনি খাতাটি চেয়ে নিয়ে যান। তিনিও অভিভূত হন। এমনকি ফররুখের সে খাতাটি থেকে কয়েকটি কবিতা প্রকাশও করেন তাঁর কবিতা পত্রিকার পাতায়।
৩
এবার এক নিশ্বাসে মজার কিছু তথ্য জানাই।
ফররুখ আহমদের প্রিয় শখ ছিলো ফুলের বাগান করা, দামী কলম কেনা। তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকা শুনলে জিভে জল চলে আসবে যে কোনো ভোজনরসিক মানুষের। শিক কাবাব, টিকিয়া, চালকুমড়ার মোরব্বা, আম, আরবী খেজুর ইত্যাদি খাবার তিনি ভীষন পছন্দ করতেন। পোশাকের মধ্যে পছন্দ করতেন পাজামা-পাঞ্জাবী। তাঁর প্রিয় শিল্পী ছিলেন শচীন দেব বর্মন, বেদার উদ্দীন আহমেদ, আব্দুল আলীম আর আব্বাস উদ্দীন প্রমুখ। ও পদ্মার ঢেউরে ও এবার/তুমি জানিতে চেয়ো না আমারে—এই গানটা ছিলো তাঁর পছন্দের।
ফররুখ আহমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আমার ভালোলাগার একটি দিক হচ্ছে—তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের মতো করে ভাবতেন। ঠিক এ কারণেই বোধহয় খুব ছোট থেকেই আমি তাঁকে পছন্দ করি। ছন্দে ও শব্দে শব্দে তিনি শিশুকিশোরদের আনন্দজগতে ভ্রমণ করানোর পাশাপাশি় তাদের উপদেশ দিয়ে লিখেছেন,
নতুন সফরে শুরু হোক আজ জীবন সেই,
মুক্ত প্রাণের রোশনিতে ভয়-শংকা নেই।
নবীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে লিখেছেন,
আমরা সকল দেশের শিশু যাবো
নবীর মদীনায়
তোরা সঙ্গে যাবি আয়!
শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যেতে কার না ইচ্ছে করে! সেই ইচ্ছে আরো প্রবল হয় যখন পড়ি,
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে
পাখির বাসা খুঁজতে যাবো একসাথে।
কবি ফররুখের কাজ অসীম বিস্তৃত নয়। স্কুল-মাদরাসার পাঠ্যবইয়ের বাইরে তাঁর কবিতা আমরা খুব কমই জানি। অথচ তাঁর রচিত একুশটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে কেবল শিশুকিশোরদের জন্যই। শিশুতোষ রচনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তাঁর শিশুসাহিত্য খুব একটা আলোচিত হয় না।
শাশ্বত সত্য এই যে, প্রিয় কবি তাঁর এই ‘অল্প-বিস্তর’ ও ‘অসমাপ্ত’ সৃষ্টকর্মের মাধ্যমেই অমরত্বের বিশাল পথে রেখে গেছেন সোনালী পদছাপ। ক্ষণজন্মা এই কবিপুরুষ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে যাত্রা করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর। পবিত্র রমজানুল কারিমে পৃথিবীর আলো দেখা মানুষটি চিরতরে চোখ বুজেন আরেক রমজানুল কারিমে।
কবি ফররুখকে আমি কেবল জন্ম কিংবা মৃত্যুদিবসে স্মরণ করি না। স্মরণ করি সতত… তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য… তাঁর শুদ্ধ চেতনা ও বিশুদ্ধ প্রেরণার জন্য… তাঁর আত্মার পবিত্রতা ও হৃদয়ের স্বচ্ছতার জন্য… শুধু আমিই নয়, আমার মতো হাজারো-লাখো মানুষের হৃদয়মন্দিরে ফররুখরা বসবাস করেন যুগ-যুগান্তরে। অমর হয়ে থাকেন কালান্তরে।